বাঙালি জাতির দুটি অভূতপূর্ব সন্ধিক্ষণে এ বছর ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার পূরণের ১৩ বছর পূর্ণ হচ্ছে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন চলছে। আর ২৬ মার্চ আমরা উদযাপন করেছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এমনি স্মরনীয় মুহুর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেরণাদায়ি ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের আমরা কতোটা সফল তা মানুষের কাছে তুলে ধরার দায়বদ্ধতা যেমন রয়েছে তেমনি বিশ্বে ডিজিটাল বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বিজ্ঞান, কারিগরি ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশের ভিত যার হাত ধরে রচিত হয়েছিল প্রাসঙ্গিকভাবে তা-ও বিধৃত করার প্রয়োজন রয়েছে।
ডিজিটাল বিপ্লবের শুরু ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট আবিস্কারের ফলে। ইন্টারনেটের সাথে ডিভাইসের যুক্ততা মানুষের দৈনন্দিন জীবন, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বানিজ্য, উৎপাদনে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। বিজ্ঞান, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফলে বিশ্বে উন্নয়ন দারুণ গতি পায়। দূরদর্শী রাষ্ট্রনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর গুরুত্ব গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। কারণ তিনি গড়তে চান সোনার বাংলা। তাঁর এই স্বপ্নের বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ১৯৭৩ সালের ১৮ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণে তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলাম, আজ স্বাধীনতা পেয়েছি। সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছি; সোনার বাংলা দেখে মরতে চাই।
সোনার বাংলা দেখার প্রত্যাশা পূরণে মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে প্রজ্ঞাবান ও বিচক্ষণ রাষ্ট্রনেতা বঙ্গবন্ধু কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এমন কোন খাত নেই যেখানে পরিকল্পিত উদ্যোগ ও কার্যক্রমের বাস্তবায়ন করেননি। শুধু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিকাশে গৃহীত নানা উদ্যোগ ও কার্যক্রমের দিকে তাকালে দেখা যাবে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই রচিত হয় একটি আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশের ভিত্তি, যা বাংলাদেশকে ডিজিটাল বিপ্লবে অংশগ্রহণের পথ দেখায়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ১৫টি সংস্থার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্যপদ লাভ করে। আর্থ-সামাজিক জরিপ, আবহাওয়ার তথ্য আদান-প্রদানে আর্থ-রিসোর্স টেকনোলজি স্যাটেলাইট প্রগ্রাম বাস্তবায়িত হয় তাঁরই নির্দেশে। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইটের আর্থ স্টেশনের উদ্বোধন করেন। বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা ও কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে কুদরত-এ খুদার মতো একজন বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রণয়ন এবং শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগগুলো ছিল তাঁর অত্যন্ত সুচিন্তিত ও দূরদর্শী। পারস্পারিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শীতার বোঝা যায়, ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে দেওয়া তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য স্বনির্ভরতা। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, সম্পদ ও প্রযুক্তিবিদ্যার শরিকানা মানুষের দুঃখ, দুর্দশা হ্রাস করিবে এবং আমাদের কর্মকান্ডকে আরও সহজতর করিবে, ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। নতুন বিশ্বের অভ্যূদয় ঘটিতেছে। আমাদের নিজেদের শক্তির উপর আমাদের বিশ্বাস রাখিতে হইবে। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। থেমে যায় সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্ন, ডিজিটাল বিপ্লবের পথে পথ চলা। শুধু কী তা-ই। পঁচাত্তর পরবর্তী ২১ বছরের শাসনামলে বিনা অর্থে ইন্টারনেট কেবল লাইনে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করে দেশের মানুষ। ১৯৯২ সালে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার রাষ্ট্রীয় গোপণ তথ্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে এমন ঠুনকো ও অবিচবচনাপ্রসূত অজুহাত দেখিয়ে আন্তর্জাতিক সাবমেরিন কেবল সি-মি-উই –এ যুক্ত হওয়া থেকে বিরত থাকে।
মানুষকে হত্যা করা যায়। কিন্তু তার স্বপ্ন ও দর্শনকে হত্যা করা যায় না। বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আরেক দূরদর্শী নেতা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসুরী দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচিত করে। দেশ পরিচালনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিকাশের ওপর গুরুত্ব দেন। কম্পিউটার আমদানীতে শুল্ক হ্রাস ও মোবাইল ফোনের মনোপলি ভেঙ্গে তা মানুষের কাছে সহজলভ্য করেন। ১৯৯৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভায় গাজীপুরের কালিয়াকেরে হাই-টেক পার্ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর দিন বদলের সনদ রূপকল্প ২০২১ এর মূল উপজীব্য হিসেবে ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘোষণা আসে ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশকে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও জ্ঞানভিত্তিক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা দেন। ঘোষনায় বলা হয়, ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ পরিণত হবে ডিজিটাল বাংলাদেশে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ আসলে সোনার বাংলার আধুনিক রূপ, যার বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০০৯ সালে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা দেশের সব মানুষের উন্নয়ন অগ্রাধিকার দিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিকাশ, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ডিজিটাল অর্থনীতি ও ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ে তোলায় ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ গ্রহণ করা হয়। এসব কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নের জন্য আইন, নীতিমালা প্রণয়ন থেকে শুরু করে সামগ্রিক কার্যক্রমের পরামর্শ ও তদারকি করছেন ডিজিটাল বাংলাদেশের আর্কিটেক্ট মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা জনাব সজীব ওয়াজেদ জয়। ফলে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের বিগত ১২ বছরের পথ চলায় দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মানুষ ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের সুফল পাচ্ছে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, শিল্প, ব্যবসা-বানিজ্য, দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মসংস্থান এমন কোন খাত নেই তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সমাধান ব্যবহৃত হচ্ছে না। এটা সম্ভব হচ্ছে মূলত সারাদেশে একটি শক্তিশালী আইসিটি অবকাঠামো গড়ে ওঠার কারণে, যা গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে প্রতি এমবিপিএস ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের দাম ছিল ৭৮ হাজার টাকা। বর্তমানে প্রতি এমবিপিএস ৩শ টাকার নীচে। দেশের ১৮ হাজার ৫ সরকারি অফিস একই নেটওয়ার্কের আওতায়। ৩৮শ ইউনিয়নে পৌঁছে গেছে উচ্চগতির (ব্রডব্যান্ড) ইন্টারনেট। ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতায় মানুষের তথ্যপ্রযুক্তিতে অভিযোজন ও সক্ষমতা দুই-ই বেড়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে মোবাইল সিম ব্যবহারকারি প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি। ইন্টারনেট ব্যবহারকারি বর্তমানে ১১ কোটিরও বেশি। ডব্লিউইএফ এর প্রতিবেদনে যথার্থভাবেই মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে গ্রামীন এলাকায় আর্থসামাজিক ব্যবধান কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। বাস্তবেও দেখা যাচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে আর্থিক সেবায় মানুষের অন্তর্ভুক্তি রীতিমতো বিস্ময়কর। বিশেষ করে মেবাইল ব্যাংকিং সেবা বহির্ভুত অধিকাংশ (প্রায় ৬০ শতাংশ) মানুষকে (যাদের আবার অধিকাংশই গ্রামের মানুষ) ব্যাংকিং সেবার অন্তর্ভুক্ত করেছে। ১০ বছর আগে চালু হওয়া মোবাইল ব্যাংকিং খাতে নিবন্ধিত গ্রাহকের সংখ্যা ৯ কোটি ৬৪ লাখ এবং ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে লেনদেন ৫৩ হাজার ২শ ৫৮ কোটি টাকা এবং ২০২১ সালের এপ্রিলে তা ৬৩ হাজার ৪শ ৭৯ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।
অনলাইন ব্যাংকিং, ইলেক্ট্রনিক মানি ট্রান্সফার, এটিএম কার্ড ব্যবহার শুধু ক্যাশলেস সোসাইটি গড়াসহ ই-গভর্মেন্ট প্রতিষ্ঠায় ভুমিকা রাখছে তা নয়, ই-কমার্সেরও ব্যাপক প্রসার ঘটাচ্ছে। ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত ই-কমার্সের আকার ছিল ৮হাজার ৫শ’ কোটি টাকা, যা করোনা মহামারিতে দ্বিগুণ হয়েছে। আগামী ২০২৩ সাল নাগাদ দেশীয় ই-কমার্সের বাজার ২৫ হাজার কোটিতে পৌঁছাতে পারে। এছাড়া, ৫০ হাজারেরও বেশি ফেসবুকভিত্তিক উদ্যোক্তা যারা ৩০ হাজারেরও বেশি পণ্য হস্তান্তরে যুক্ত। এরমধ্যে ১২ হাজার পেইজ চালাচ্ছেন নারীরা। দেশের গ্রাম ও প্রান্তিক এলাকায় ই-কমার্সের প্রসারে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘একশপ’, যেখানে প্রান্তিক অঞ্চলের পণ্য উৎপাদনকারীরা কোন মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াই নিজেদের পণ্য বিক্রি করতে পরছেন।
স্টার্টআপ সংস্কৃতির বিকাশে সরকারের নানা উদ্যোগে ভাল সুফল পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে দেশে স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে আইডিয়া প্রকল্প ও বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্রান্ট (বিগ) এর মাধ্যমে স্টার্টআপগুলোতে অনুদান দেওয়া, স্টার্টআপে বিনিয়োগ করার জন্য স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড নামে সরকারি ভেঞ্চার কোম্পানি, ৫ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধন নিয়ে শেয়ার বাজারে যাওয়ার সুযোগ, শেয়ারবাজারে পৃথক এসএমই বোর্ড চালু করা, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ভেঞ্চার তহবিল পরিচালনার নীতিমালা প্রণয়ন দেশে স্টার্ট আপ বিকাশের পথ সুগম করে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১.৫ হাজার স্টার্টআপ রয়েছে। যাদের অধিকাংশই পরিচালনা করছে তরুণরা। স্টার্টআপে বিনিয়োগ প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ই-গভর্মেন্ট কার্যক্রমে বাংলাদেশকে প্রায় দুইশ’ বছর ধরে বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলের প্রচলিত সেবা প্রদানের পদ্ধতির ডিজিটাইজেশন করা হয়। ৫২ হাজারেরও বেশি ওয়েবসাইটের জাতীয় তথ্যবাতায়নে যুক্ত রয়েছে ৮৬.৪৪ লক্ষেরও অধিক বিষয়ভিত্তিক কনটেন্ট এবং ৬শ’রও বেশি সেবা, যা সহজেই মানুষ অনলাইনে পাচ্ছে। প্রায় ৮ হাজার ডিজিটাল সেন্টার থেকে ৬০ কোটি সেবা দেওয়া হয়, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ গ্রামের। বিগত প্রায় এক যুগে নাগরিকরা অনলাইনে তথ্য ও সেবা পেয়ে কীভাবে উপকৃত হয়েছে তার একটা হিসাব তুলে ধরছি। এ সময়ে নাগরিকদের ১.৯২ বিলিয়ন দিন, ৮.১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ এবং ১ মিলিয়ন যাতায়ত হ্রাস পায়। ২০২৫ সাল নাগাদ যখন শতভাগ সরকারি সেবা অনলাইনে পাওয়া যাবে তখন নাগরিকদের সময়, খরচ ও যাতায়ত সাশ্রয়ের পরিমাণ কী পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে তা সহজেই অনুমেয়। ই-নথিতে ১ কোটি ৫০ লাখ ফাইলের নিষ্পক্তি হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ২৬ লক্ষ ই-মিউটেশন করা হয় অনলাইনে। ‘ফোর টায়ার ন্যাশনাল ডাটা সেন্টার’ প্রকল্পের আওতায় দেশে একটি সমন্বিত ও বিশ্বমানের ডাটা সেন্টার গড়ে তোলা হচ্ছে। এর ফলে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ই-সেবা সংরক্ষণের ক্ষমতা বৃদ্ধি, ই-সেবাসমূহের সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে জনসেবা উন্নত হবে। বিভিন্ন ই-সেবাসমূহের মধ্যে যে ইন্টারঅপারেবেলিটি সমস্যা দূরীকরণ ও প্রক্রিয়া সহজসাধ্য করার জন্য বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডিজিটাল আর্কিটেকচার (বিএনডিএ) তৈরি করা হয়েছে। ‘ই-গভ মাস্টার প্ল্যান’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর আওতায় বাংলাদেশের ৯টি পৌরসভা ও ১টি সিটি কর্পোরেশনে ডিজিটাল মিউনিসিপালিটি সার্ভিস সিস্টেম (ডিএমএসএস) উন্নয়নের মাধ্যমে নাগরিক সেবাসমূহ অনলাইন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের সকল পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনে ডিএমএসএস বাস্তবায়ন করা হবে।
ডিজিটাল অর্থনীতির ক্ষেত্রেও ইতিবাচক ধারা পরিলক্ষিত হচ্ছে। আইসিটি রপ্তানী ২০১৮ সালেই ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়। অনলাইন শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ ফ্রিল্যান্সারের আউটসোর্সিং খাত থেকে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে। ৩৯টি হাই-টেক/আইটি পার্কের মধ্যে ইতোমধ্যে নির্মিত ৭টিতে দেশি-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ব্যবসয়াকি কার্যক্রম শুরু করেছে। এরমধ্যে ৫টিতে ১২০টি প্রতিষ্ঠান ৩২৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। ১৩ হাজারের অধিক কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। হাই-টেক পার্কগুলোর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে সম্পন্ন হলে ৩ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে হাই-টেক/আইটি পার্কগুলোতে ২৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
করোনা মহামারিতে যখন গোটা বিশ্ব টালমাটাল। পরিস্থিতে মোকাবেলায় এমনকি উন্নত দেশগুলোও হিমসিম খাচ্ছিলো তখনও সরকারের বিভিন্ন ডিজিটাল উদ্যোগ মানুষকে দেখিয়েছে নতুন পথ, যুগিয়েছে প্রেরণা। করোনাকালে ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠক, আদালতের কার্যক্রম, বিজনেস কনটিনিউটি প্লান অনুসারে অফিস, ব্যবসা-বানিজ্যের কার্যক্রমসহ প্রায় সবকিছুই চলমান রাখা হয়। মহামারির মধ্যেও প্রযুক্তির সহায়তায় ব্যবসা-বানিজ্যসহ অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালু থাকায় তা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখছে। প্রযুক্তির সহায়তায় করোনা সচেতনতা, বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা এবং স্বাস্থ্যসেবাসহ সকল ধরনের সেবা দেশের কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩ এর মতো একটি ফোন সেবার মাধ্যমে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, নিত্যপণ্য সরবরাহসহ সরকারি তথ্য ও সেবা প্রদান করে আসছে। করোনাভাইরাস সংক্রান্ত যেকোনো প্রয়োজনীয় পরামর্শ, করোনা সম্পর্কিত সকল সেবার হালনাগাদ তথ্যের জন্য করোনা পোর্টাল তৈরি করেছি, যার মাধ্যমে কোটি মানুষকে করোনা সম্পর্কিত তথ্য প্রদান করা হয়েছে। সরকারি অফিসগুলোতে চালুকৃত ই-নথি ব্যবস্থা সেবা কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করেছে। শুধুমাত্র করোনা মহামারির সময়ে ৩০ লাখের অধিক ই-নথি সম্পন্ন হয়েছে। এতে করে সরকারি সেবা কার্যক্রম নাগরিকের কাছে আরো সহজে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেবাকে আরো ত্বরান্বিত করতে চালু করা হয়েছে স্পেশালাইজইড টেলিহেলথ সেন্টার। পাশাপাশি গর্ভবতী ও মাতৃদুগ্ধদানকারী মা ও শিশুর নিরবচ্ছিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে মা টেলিহেলথ সেন্টার সার্ভিস তৈরি করা হয়েছে, এর মাধ্যমে লক্ষাধিক মা ও শিশুকে সেবা প্রদান করা হয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশীদেরও প্রবাস বন্ধু কলসেন্টারের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে আসছে। প্রযুক্তিনির্ভর বাজার ব্যবস্থায় ফুড ফর নেশনের মতো প্লাটফর্মের মাধ্যমে সারাদেশের উদ্যোক্তাদেরকে যুক্ত করা হয়েছে। করোনা ট্রেসার বিডি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাসমূহ চিহ্নিতকরণের কাজ করছে। এছাড়াও গুজব ও অসত্য তথ্য রোধে দেশব্যাপী ‘সত্যমিথ্যা যাচাই আগে ইন্টারনেটে শেয়ার পরে’, ‘ আসল চিনি’ ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা হয়েছে। করোনাকালীন সময়ে আইসিটি বিভাগের সহযোগিতায় সারাদেশের ১ লাখ ১০ হাজার গুরুত্বপূর্র্ণ স্থান গুগল ম্যাপ ও ওপেন স্ট্রিট ম্যাপে যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫ হাজার হাসপাতাল, ১৬ হাজার ফার্মেসি এবং ২০ হাজার মুদি দোকান সন্নিবেশিত করার পাশাপাশি ৮শ’৭০টি রাস্তা ম্যাপে যুক্ত করা হয়েছে।
দেশব্যাপী লকডাউনে শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম যেন থেমে না যায় সেজন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগিতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমকি ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসা এবং কারিগরি পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজিটাল কনেটেন্ট তৈরি করে তা সংসদ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে দেশব্যাপী সম্প্রচার করা হচ্ছে। অনলাইনে ক্লাস প্রচারিত হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৬শ’ ৬৮টি এবং আপদকালীন সময়ে শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছেন প্রায় ৫ হাজার ৮৬ জন শিক্ষক। এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রম এবং সরকারি-বেসরকারি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়মিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ডিজিটাল মাধ্যমে কার্যকরী ও সহজ উপায়ে চলমান রাখতে ‘ভার্চুয়াল ক্লাস’ প্লাটফর্ম চালু করা হয়েছে। এ প্লাটফর্মের মাধ্যমে লাইভ ক্লাস বা ট্রেনিং পরিচালনা, এডুকেশনাল কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট, মূল্যায়ন বা অ্যাসেসমেন্ট টুলস, মনিটরিং এবং সমন্বয় করার প্রযুক্তি যুক্ত রয়েছে।
কৃষি প্রধান বাংলাদেশে এই ক্ষেত্রও প্রযুক্তির ছোঁয়া বদলে দিয়েছে কৃষকের জীবন। তথ্যপ্রযুক্তিগত সেবা ‘কৃষি বাতায়ন’ এবং ‘কৃষক বন্ধু কলসেন্টার’ চালু করা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন কৃষি বিষয়ক সেবাগুলোর জন্য কলসেন্টার হিসেবে কাজ করছে ‘কৃষক বন্ধু’ (৩৩৩১ কলসেন্টার)। ফলে সহজেই কৃষকেরা ঘরে বসে বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করতে পারছেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকার লক্ষ্যের চেয়েও অনেক বেশি অর্জন করেছে। বিগত একযুগে ডিজিটাল বাংলাদেশের কর্মযজ্ঞ শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন এবং সেবা প্রদানের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এর বিস্তৃতি ছড়িয়েছে বিশ্বজুড়ে। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া সাউথ-সাউথ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সোমালিয়া, নেপাল, ভূটান, মালদ্বীপ, ফিজি, ফিলিপিন্স এবং প্যারাগুয়ে এর সাথে সমঝোতার মাধ্যমে এসডিজি, ওপেন গভর্নমেন্ট ডাটা, চেইঞ্জ ল্যাবসহ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান এবং সেবা বা সিস্টেম আদান-প্রদান করা হচ্ছে। যেখানে পাঁচটি বেস্ট প্র্যাকটিস চিহ্নিত করা হয়েছে। বেস্ট প্র্যাকটিসগুলো হচ্ছে ডিজিটাল সেন্টার, সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ড, এ্যাম্পেথি ট্রেনিং, টিসিভি এবং এসডিজি ট্রেকার। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হওয়া এসকল ডিজিটাল কার্যক্রমের মডেল বাস্তবায়িত হচ্ছে বিদেশের মাটিতেও। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে নানা উদ্যোগ ও কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশের ঝুঁলিতে এসেছে জাতিসংঘের সাউথ-সাউথ কো-অপারেশন অ্যান্ড ভিশনারি অ্যাওয়ার্ড, আইসিটি সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, ওয়ার্ল্ড সামিট অন দ্য ইনফরমেশন সোসাইটি (ডব্লিউএসআইএস) অ্যাওয়ার্ডসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার।
আমরা এখন কৃত্রিম, বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকস, ব্লকচেইন , ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) এর মতো ফ্রন্টিয়ার প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা কাজে লাগানো ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রস্তুতি নিচ্ছি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইওটি, রোবোটিক্স, সাইবার সিকিউরিটির উচ্চপ্রযুক্তির ৩১টি বিশেষায়িত ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর স্থাপন করা হবে। প্রযুক্তি ও জ্ঞাননির্ভর প্রজন্ম বিনির্মাণের লক্ষ্যে প্রতিটি জেলায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে পঞ্চম প্রজন্মের প্রযুক্তি চালুর লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান, কারিগরি ও প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশের যে ভিত্তি তৈরি করে গেছেন সে পথ ধরেই ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ করে বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ আজ স্যাটেলাইটের এলিট ক্লাবের সদস্য। আমাদের লক্ষ্য ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যে প্রসার ঘটেছে তাকে কাজে লাগিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা ও ২০৪১ সাল নাগাদ একটি জ্ঞানভিত্তিক উন্নত বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলা।
লেখক: জুনাইদ আহ্মেদ পলক, এমপি, প্রতিমন্ত্রী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ।