ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাগান্না ইউনিয়নের বাথপুকুরিয়া গ্রামের একাধিক ব্যক্তির বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতার টাকা ‘নগদ’ অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। টাকা উদ্ধারের জন্য তারা গত শনিবার ঝিনাইদহ সদর থানা পুলিশের দারস্থ হন। পুলিশ ঘটনাটি তদন্ত করে প্রাথমিকভাবে সত্যতা পেয়েছে।
ভাতাভোগীদের অভিযোগ, স্থানীয় সাগান্না ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বর আব্দুল ওহাবের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত রাজন নামে এক কলেজছাত্র এই টাকা উঠিয়ে নিয়েছেন। ডাকবাংলা বাজারের নগদ’র এজেন্ট হবিবুর রহমানও স্বীকার করেছেন রাজন মাঝে মধ্যে এসে ভাতা ভোগীদের টাকা উঠিয়ে নিয়ে যায়।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ডাকবাংলা পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই মাখন বিশ্বাস এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, বিষয়টি আমলে নিয়ে সরেজমিন তদন্ত করে দেখা যায় বাথপুকুরিয়া গ্রামের প্রায় ৬/৭ জন বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি তাদের ভাতার টাকা পাননি। বিষয়টি প্রযুক্তিগত ও জটিল হওয়ায় তিনি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানালে ভুক্তভোগীদের থানায় ডেকে তাদের বক্তব্য শোনেন। ভাতাভোগীরা ইউপি মেম্বরের সহযোগী বাথপুকুরিয়া গ্রামের শাহিন মিয়ার ছেলে রাজনকে অভিযুক্ত করে বক্তব্য দেন।
জেলা সমাজসেবা অফিসের হিসাব মতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে চতুর্থ কিস্তির টাকা শৈলকুপায় ১২ জনের, সদর উপজেলায় ১৭ জনের, কালীগঞ্জে ৭ জনের, হরিণাকুন্ডুতে ১৪ জনের ও ঝিনাইদহ পৌরসভায় ১৫২ জনের উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া দ্বিতীয় কিস্তির টাকা শৈলকুপায় ১৪ জনের, কোটচাঁদপুরে ৫ জনের, ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় ১৮ জনের, মহেশপুর উপজেলায় ১৫৯ জনের, কালীগঞ্জে ২৮ জনের ও হরিণাকুন্ডুতে ৪৯ জনের নগদ অ্যাকাউন্ট থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ঝিনাইদহ শহরের মদনমোহন পাড়ার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বিমল কুমার ঘোষাল অভিযোগ করেন, তার ০১৪০৩-০৫৮৬১১ নাম্বারের নগদ অ্যাকাউন্ট থেকে বয়স্ক ভাতার টাকা উধাও হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে তিনি ঝিনাইদহ সদর থানায় জিডি করেছেন। এখনো কোনো প্রতিকার পাননি।
শৈলকুপা উপজেলার ফুলহরি গ্রামের হাসি রানী অভিযোগ করেন, তিনি নতুন ভাতাভোগী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। কিন্তু প্রথম কিস্তির টাকা তিনি পাননি। নগদ অ্যাকাউন্ট চেক করে দেখেন তার টাকা কে বা কারা তুলে নিয়েছে।
ঝিনাইদহ পৌর এলাকার কালিকাপুর গ্রামের ফারজানা আফরিন এ্যানী জানান, অসহায় প্রতিবন্ধী হিসেবে তিনি প্রতিমাসে ভাতা পেয়ে আসছেন। তিনি নগদ একাউন্ট খোলার পর তার নগদ ০১৯৬৯১৯—৩ নাম্বারের সাড়ে চার হাজার টাকা প্রতিবন্ধী ভাতা আসে। কিন্তু সেই টাকা গত ৯ জুলাই কে বা কারা ০১৯০৬৪৯—১ নাম্বারে ট্রান্সফার করে নেয়। এ ঘটনায় তিনি ১৯ আগস্ট ঝিনাইদহ সদর থানায় একটি জিডি (নং ৯৯২) করেন। কিন্তু এখনো টাকা ফিরে পাননি।
প্রতিবন্ধী ফেরদৌছি বেগম অভিযোগ করেন, রাজন তাদের বই ও সিমসহ মোবাইল নিয়ে যায়। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা নেই। টাকা তুলে দেওয়ার কথা বলে দুইশ টাকাও নেয় রাজন।
একই কথা জানান, বাথপুকুরিয়া গ্রামের আছিয়া বেগম, আমেনা খাতুন, প্রতিবন্ধী নুর আলম ও বাবুল। তাদের ভাষ্য, কলেজছাত্র রাজন টাকা উত্তোলনের কথা বলে নিজেই তাদের টাকা তুলে নিয়েছে। এই টাকা তুলে তিনি ৫০ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনেছে।
আব্দুল খালেক নামে এক প্রতিবন্ধীর বাবা জানান, ব্যাংক থেকে যখন টাকা প্রদান করা হতো, তখন তাদের কোনো টাকা খোয়া যায়নি। মোবাইল ব্যাংকিং চালু হওয়ার পর তাদের এলাকার বহু মানুষের ভাতা নগদ অ্যাকাউন্ট থেকে হাওয়া হয়ে গেছে।
অভিযোগের বিষয়ে কলেজছাত্র রাজন জানান, তিনি কারো টাকা উত্তোলন করেননি। ‘নির্বাচন চলছে, তাই প্রতিপক্ষরা আমার ওপর এ রকম মিথ্যা দায় চাপাচ্ছে।
স্থানীয় সাগান্না ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বর আব্দুল ওহাব বলেন, ইউপি নির্বাচন নিয়ে দলাদলির কারণে এ ধরনের মিথ্যা অভিযোগ থানায় দেওয়া হয়েছে। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো তার ওয়ার্ডেও নগদ অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহে শত শত মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির টাকা ‘নগদ’ অ্যাকাউন্ট থেকে উধাও হয়ে গেছে। অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে কে বা কারা হতদরিদ্রদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, তার রহস্য এখনো সমাজসেবা অধিদফতর জানাতে পারেনি। টাকার শোকে হতদরিদ্ররা আহাজারি করলেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, জেলায় এ রকম শত শত অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু তাদেরকে কোনো সহায়তা দিতে পারছে না তারা। কোনো কোনো উপজেলায় ৫% থেকে ১০% টাকা হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে। ঝিনাইদহ পৌরসভা এলাকার বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার ১৩৬ জন বয়স্ক, ৪ জন বিধবা, ২৩ জন প্রতিবন্ধী ও ৪ জনের শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা তাদের নগদ অ্যাকাউন্ট থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই টাকার পরিমাণ প্রায় ৪৭ লাখ। অনেক ভাতাভোগীর অ্যাকাউন্ট খোলার আগেই টাকা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ শেখ টেকজুমকে বলেন, নগদ অ্যাকাউন্ট খোলার পর ‘নগদ’ কর্মীদের দেওয়া গোপন পিন নাম্বার দিয়ে অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করতে পারেনি ভাতাভোগীরা। সমাজসেবা থেকে এমন অভিযোগ অধিদফতরে দিলে সব গোপন পিন ‘অটো রিসেট’ করে দেওয়া হয়। পরে ভাতাভোগীরা গোপন পিন রিসেট করে দেখেন তাদের অ্যাকাউন্টের টাকা আগেই তুলে নেওয়া হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ঝিনাইদহ থেকে ঠিক কতজনের টাকা ‘নগদ’ অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে তুলে নেওয়া হয়েছে, তার সঠিক হিসাব নেই। তবে আমরা প্রাথমিকভাবে এক হাজার ভাতাভোগীকে শনাক্ত করতে পেরেছি। তাদের তালিকা সমাজসেবা অধিদফতরে অবহিত করেছি।