ডলার সংকটের সুযোগ নিয়ে সরাসরি ডিজিটাল হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) অপারেটর। এই অভিযোগে এমএফএস অপারেটর বিকাশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রায় ৩০০ এজেন্টের সিম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন ডিসট্রিবিউটরের লেনদেন কার্যক্রমও স্থগিত রয়েছে। এমনকি ব্লক হওয়ার আশঙ্কায় কিছু এমএফএস অপারেটর নিজেরাই তাদের বিকাশ কার্যক্রম বন্ধ রেখেছেন।
চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা অঞ্চলের বেশ কয়েকজন ডিস্ট্রিবিউটরের সাথে কথা বলে ‘বিকাশ এজেন্ট সিম’ বন্ধ করে দেওয়ার সত্যতা মিলেছে।
কুমিল্লা অঞ্চলের এক ডিস্ট্রিবিউটর মঙ্গলবার রাতে বলেন, ডলারের ঊর্ধ্বগতির কারণে ডিজিটাল হুন্ডির কার্যক্রম বেড়ে গেছে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিষয়টি তদারকি করছে। যাদের লেনদেনে এ ধরনের কার্যক্রমের প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাদের লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ইদানীং এ ধরনের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় আমি কয়েকদিন আগেই ‘বিকাশ এজেন্ট’ বন্ধ রেখেছি।
এজেন্ট নম্বর বন্ধ হলে জমা টাকা ফেরত পাওয়া যায় কিনা- এমন প্রশ্নে একজন ডিস্ট্রিবিউটর জানান, বিকাশের কাছে আবেদন করলেই তারা ট্রানজেকশন চেক করে টাকা রিফান্ড করে দেয়।
গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেওয়ায় হুন্ডি বা অবৈধ পথে অর্থ লেনদেন অনেকটাই কমেছিল। কম খরচে দ্রুত পাঠাতে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসী আয় আসা বেড়ে যায়। কিন্তু গত কয়েকদিন ডলারের বিনিময়মূল্য বেড়ে যাওয়ায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অবৈধ ব্যবহার বেড়েছে। ফলে প্রবল প্রতাপে আবার ফিরে এসেছে সেই হুন্ডি ব্যবস্থা। ব্যাংকাররা এর নাম দিয়েছেন ‘ডিজিটাল হুন্ডি’।
বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) অতিরিক্ত পরিচালক মো. কামাল হোসেন বলেন, ডিজিটাল হুন্ডির কারণে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর প্রভাব সৃষ্টি করেছে। প্রভাব পড়ছে রিজার্ভ, আমদানিতেও। এটার বিরূপ প্রভাব পড়ছে পুরো দেশে। এমনকি বিভিন্ন ব্যাংকের এক্সচেঞ্জ হাউসও লোকসানে। অর্জিত বিদেশি মুদ্রা এখন আর দেশে আসছে না। কমছে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। একইভাবে ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচারও বেড়ে গেছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের এক সদস্য জানান, বিদেশ থেকে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা প্রবাসীদের পরিবার-পরিজনের কাছে অর্থ পাঠানোর জন্য স্থানীয় এজেন্টের কাছে ই-মেইল, এসএমএস, মেসেঞ্জার, ইমো কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে তাৎক্ষণিক বার্তা (মেসেজ) পাঠান। ওই বার্তা ধরে স্থানীয় এজেন্টরা সুবিধাভোগীর কাছে বৈধ চ্যানেলেই অর্থ পৌঁছে দেন। এক্ষেত্রে ব্যাংকিং চ্যানেল ও মোবাইলে আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান (এমএফএস) সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন অ্যাপের সহায়তায় এজেন্ট ছাড়াই দেশে টাকা পাঠানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, ডিজিটাল হুন্ডির হাত ধরে দেশ থেকে অর্থ পাচারও বাড়ছে। কারণ একই পন্থায় স্থানীয় হুন্ডি ব্যবসায়ীরা তাদের বিদেশি এজেন্টদের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারে সহায়তা করছেন।
জানা গেছে, ৪ বছর আগেও হুন্ডি ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমেছিল। কিন্তু করোনার সময় হুন্ডি ব্যবসায়ীরা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। সর্বশেষ ডলারের দাম বাড়ার কারণে এই অপতৎপরতা নতুন গতি পেয়েছে। এ অবস্থায় বিদেশ থেকে অর্থ পাঠাতে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা কী ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করছে, তা খতিয়ে দেখতে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগ থেকে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার ওপর মতামত দেওয়া হয়েছে। এরপরই নড়েচড়ে বসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। অভিযান পরিচালনায় মাঠে নামানো হয়েছে ১০টি টিম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বেশ কিছুদিন ধরেই বিদেশ থেকে টাকা আনা ও পাচারের ক্ষেত্রে ডিজিটালি কোন ধরনের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হচ্ছে, তা নিয়ে তদন্ত করছে। এর আগে তারা রিং আইডিসহ বেশ কিছু প্রতারকের মাধ্যমে অর্থ পাচার ও হুন্ডি হচ্ছে বলে জানিয়েছিল। সেই অর্থ এই দেশে তাদের এজেন্টরা লেনদেন করছিলেন বিকাশের মাধ্যমে। আর এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা পেয়েই সিম বন্ধ শুরু করে বিকাশ।
সাধারণত একজন বিকাশ এজেন্টের দৈনিক লেনদেনে ক্যাশ-ইন ও আউটে খুব বেশি হেরফের হয় না। অর্থাৎ ক্যাশ আউটের কাছাকাছি থাকে ক্যাশ-ইনের পরিমাণ। কিন্তু অভিযুক্ত নম্বরগুলোয় অস্বাভাবিক হারে ক্যাশ-ইন হয়েছে গত কিছুদিন। যেগুলোর তদন্ত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
বিকাশ এজেন্ট বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের ভাষ্য কী- জানতে চাইলে চট্টগ্রামের এক ডিস্ট্রিবিউটর বলেন, বিকাশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করলে তারা আমাদের জানায়; বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী কিছু অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেনের কারণে হয়ত তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছে। বিষয়টি তদন্তের পর সঠিক তথ্য জানানো হবে বলে জানিয়েছে।
চট্টগ্রামেরই আরেক বিকাশ ডিস্ট্রিবিউটর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘আমাদের বেশকিছু বিকাশ সিম বন্ধ হয়ে গেছে। এসব সিমে অনেক টাকাও আটকা পড়েছে। ডলারের দাম বাড়াতে প্রবাসী আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশে হুন্ডির মাধ্যমে আসছে বলে হয়ত এমনটা হতে পারে। এক্ষেত্রে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও সন্দেহ করা হচ্ছে।