আপনি কি বরাবরই আপনার ওয়্যারলেস হেডফোন চার্জ দিতে ভুলে যান? তাহলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভবত চলে এসেছে। এই সমাধান এসেছে বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক সৌরশক্তিচালিত হেডফোনের রূপ নিয়ে।
সৌরচালিত হেডফোন বাজারে এনেছে অ্যাডিডাস ও আর্বানিস্তা। ছবি: অ্যাডিডাস
আপনি কি বরাবরই আপনার ওয়্যারলেস হেডফোন চার্জ দিতে ভুলে যান? তাহলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভবত চলে এসেছে।
এই সমাধান এসেছে বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক সৌরশক্তিচালিত হেডফোনের রূপ নিয়ে। সুইডিশ প্রতিষ্ঠান আর্বানিস্তা ও জার্মান স্পোর্টস জায়ান্ট অ্যাডিডাস আলাদা দুটি হেডফোন বাজারে এনেছে। দুটি হেডফোনের হেডব্যান্ডেই সোলার প্যানেল যুক্ত করা হয়েছে।
দুই মডেলের সোলার প্যানেলই বানিয়েছে সুইডিশ প্রতিষ্ঠান এক্সেগার। সোলার প্যানেলকে হালকা, পাতলা ও যথেষ্ট শক্তিশালী করার জন্য গত এক দশক কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এক্সেগারের বস জিওভান্নি ফিলি বলছেন, দুটি সোলার প্যানেলই পরিবেশবান্ধব ও অনায়াসে হেডব্যান্ডে এঁটে গেছে।
তিনি বলেন, ‘চার্জ দেওয়াটা সবারই অপছন্দের কাজ। তবে [মূল গ্রিডের বিদ্যুৎ ব্যবহার না করে] চার্জ করলে তা পৃথিবীর উপকারই করে।
‘নতুন প্রজন্মের তরুণরা এমন যন্ত্র চায় যা [পরিবেশের জন্য] ভালো হবে। আমরা ঠিক তা-ই দিচ্ছি।’
এক্সেগারের সোলার প্যানেলগুলোর নাম পাওয়ারফয়েল। এগুলোর পুরুত্ব মাত্র ১.৩ মিলিমিটার। টাইটানিয়াম-ডাই-অক্সাইডের স্ট্রিপের চারপাশে প্রাকৃতিক রঞ্জকের আবরণ দিয়ে এ প্যানেল তৈরি করা হয়েছে। সহজ ভাষায়, রঞ্জক আলো থেকে ফোটন শোষণ করে, যা পরে ইলেকট্রনে রূপান্তরিত হয়।
পূর্ণ রোদে একই আকারের স্ট্যান্ডার্ড সিলিকনের সোলার প্যানেলের চেয়ে প্রায় অর্ধেক সাশ্রয়ী হলেও টাইটানিয়াম-ডাই-অক্সাইডের প্যানেলগুলো একদিকে যেমন উল্লেখযোগ্যভাবে পাতলা, তেমনি এগুলো উৎপাদন করাও অনেক সহজ ও সস্তা।
সৌরচালিত হেডফোনে এখনও বিল্ট-ইন ব্যাটারি থাকে যা একবার চার্জ দিয়ে ৮০ ঘণ্টা পর্যন্ত গান শোনা বা ভিডিও দেখা যায়। পাওয়ারফয়েল সৌরশক্তির মাধ্যমে এখন হেডফোনের ব্যাটারি চার্জ করতে পারে। জিওভান্নি ফিলি বলেন, তাদের সোলার প্যানেলের মাধ্যমে ইংল্যান্ড বা সুইডেনের গ্রীষ্মকালের ২০ মিনিটের রোদ থেকে হেডফোন ১ ঘণ্টা চালানোর মতো চার্জ পাওয়া যায়।
এছাড়া ইনডোর লাইটিংয়ের মতো কৃত্রিম আলো থেকেও খানিকটা শক্তি তৈরি করতে পারে পাওয়ারফয়েল। তার মানে, একদম আলোবিহীন নিশুতি রাত ছাড়া এই হেডফোন সর্বক্ষণই চার্জ হতে থাকে। আর অনেকক্ষণ ব্যবহারের পর ব্যাকআপ শক্তির দরকার হলে যেন দ্রুত বেশ খানিকটা চার্জ করে নেয়া যায়, সেজন্য হেডফোনগুলোতে পাওয়ার সকেটও রাখা হয়েছে।
জিওভান্নি ফিলি আরও জানান, শিগগিরই মোবাইল ফোনে সোলার প্যানেল যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ বেশিরভাগ মানুষই মোবাইল ফোন রাখে প্যান্টের পকেটে। সেখানে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না। এ কারণে ফিলি ভাবছেন, সোলার প্যানেলগুলো মানুষের পোশাক ও ব্যাগের সঙ্গে লাগানো হবে, তারপর সেগুলো থেকে ফোন চার্জ করা হবে।
প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্বে রয়েছেন পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটি অভ কাতালোনিয়ার টেক্সটাইল অ্যান্ড পেপার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও ওয়্যারেবল টেক্সটাইল ইলেকট্রনিকসের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ এলিনা ইলেন।
মোবাইল ফোন চার্জ করতে সক্ষম পোশাক তৈরি না করে প্রতিষ্ঠানটি বিল্ট-ইন, সৌরচালিত সেন্সর সংবলিত পোশাক তৈরি করছে। এসব পোশাক ধোয়া যায়। পরিধানকারীর স্বাস্থ্যের বিভিন্ন দিক, যেমন হৃদস্পন্দন, তাপমাত্রা, অঙ্গবিন্যাস, ঘুমের গুণমান ও শরীরের চর্বির মাত্রাও পর্যবেক্ষণ করতে পারে এসব পোশাক।
ইলেন বলছেন, এই সোলার সেলগুলো পরিধানযোগ্য ডিভাইসে শক্তি জোগানোর মতো পর্যাপ্ত শক্তি উৎপাদন করতে পারে বটে—কিন্তু সরাসরি সূর্যের আলোতে সোলার সেলের মতো শক্তি সংগ্রহের সমান দক্ষতা এই সেলগুলোর কখনোই হবে না।
তিনি বলেন, পোশাকের পুরুত্ব, ঘনত্ব, রং—এসবই সম্ভাব্য শক্তির সংগ্রহের পরিমাণের ওপর প্রভাব ফেলবে।
তিনি আরও বলেন, পোশাকভিত্তিক পরিধানযোগ্য সেলগুলো নিয়মিত স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের জন্য অন্যতম সেরা সমাধান। কারণ এতে পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করা সহজ হবে। রোগীরা ইতিমধ্যে এসব পোশাক পরছে। আরাম নিশ্চিত করতে এই সেল কাপড়ের নিচে পরা সম্ভব বলে জানান তিনি।
লাফবরো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বিদ্যুৎ-উৎপাদনকারী কাপড়ের জন্য ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করছেন। এসব কাপড়ে তারা সৌর কোষ ব্যবহার করছেন না। বরং একজন ব্যক্তির নড়াচড়া থেকে সৃষ্ট স্থির তড়িৎ সংগ্রহ করে সেটিকে ব্যবহারযোগ্য শক্তিতে পরিণত করছেন তারা।
ট্রাইবোইলেকট্রিক ন্যানোজেনারেটর (টেংস) নামক ক্ষুদ্র শক্তি রূপান্তরকারীর ওপর ভিত্তি করে প্রযুক্তিটি তৈরি করা হয়েছে। এসব তৈরি করা হয় তুলা, পলিয়েস্টার ও নাইলনের মতো তন্তু থেকে, যার ওপরে থাকে পলিমারের আবরণ। এই পলিমার স্থির তড়িৎকে আকৃষ্ট করে। এই নমনীয়, প্রসারণযোগ্য, ধোয়া যায় এমন টেংসকে পরে পোশাক আইটেমের ফ্যাব্রিকে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।
প্রকল্প প্রধান ইশারা ধর্মসেনা বলেন, তাদের দলটি খতিয়ে দেখছে কীভাবে নিয়মিত বস্ত্র উপাদান ব্যবহার করে সাশ্রয়ী টেংস তৈরি করা যায়। এর উদ্দেশ্য, টি-শার্ট, বেজ লেয়ার ও ট্রাউজারের মতো শক্তি-উৎপাদনকারী কাপড় তৈরি করা যা আমাদের নিয়মিত পরিধেয় পোশাকের মতো, তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কিংবা শরীরের নড়াচড়া করার জন্য সেন্সর হিসাবে কাজ করতে সক্ষম।
রয়্যাল একাডেমি অভ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের রিসার্চ ফেলো ও লাফবরোর প্রভাষক ড. ধর্মসেনা আরও বলেন, ভবিষ্যতে টেংসকে সোলার প্যানেলের সঙ্গে যুক্ত করে হাইব্রিড বিদ্যুৎ-উৎপাদনকারী পোশাক তৈরি করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ওয়্যারেবল সোলার সিস্টেমস বইয়ের লেখক ডেনিস উইলসন আশা করছেন, আগামীতে সৌরচালিত পোশাকের বাজার অনেক প্রসারিত হবে।
ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অভ ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক উইলসন বলেন, পরিধানযোগ্য সোলার প্যাকগুলো এমন কিছু দিতে পারবে যেসব সুবিধা এখনও নেওয়া হয়নি।
তিনি আরও বলেন, আগামীতে প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে বড় ক্ষেত্রটি হতে পারে মোবাইল ফোন ও অন্যান্য বহনযোগ্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস চার্জে সক্ষম পোশাক। গড়পড়তা ভোক্তার জন্য এর অর্থ হতে পারে যেকোনো সময় চলার পথে বৈদ্যুতিক ডিভাইস চার্জ করতে পারা।
তবে এ ধরনের পোশাককে ব্যাপক জনপ্রিয় করতে হলে সোলার প্যানেল সিস্টেমগুলোকে অন্তত এক বছর কর্মক্ষম থাকতে হবে।