সংঘবদ্ধ চক্রের যোগসাজশে বিকাশ এজেন্টের মাধ্যমে অবৈধ লেনদেনে প্রবাসীদের টাকা আসছে বাংলাদেশে। সঠিক নিয়মে বিদেশ থেকে টাকা না আসায় সরকার বঞ্চিত হচ্ছে রেমিট্যান্স থেকে। কমছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে এসব অবৈধ লেনদেনের প্রমাণও মিলেছে। বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বেশ কয়েকবার সতর্কও করা হয়েছে। আইনের ব্যত্যয় ঘটলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রাজধানীর মিরপুর এলাকার বাসিন্দা সুমাইয়া ইসলাম লিপির বড় ভাই মো. রনি ১৪ বছর ধরে সৌদি আরবে থাকেন। বোন লিপির বিকাশ নম্বরে চলতি বছরের মে থেকে জুলাই তিন মাসে মোট ২৪ বার লেনদেদের মাধ্যমে এক লাখ ৬১ হাজার ১২০ টাকা পাঠিয়েছেন রনি। আর এই পুরো টাকাই তিনি পাঠিয়েছেন ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে।
রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা সোনিয়া বেগমের স্বামী ১০ বছর ধরে সৌদি আরবে কাজ করেন। সেখান থেকে চলতি বছরের মে-জুলাই তিন মাসে সোনিয়ার ব্যক্তিগত বিকাশ নম্বরে মোট দুই লাখ ২২ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। শুধু লিপির ভাই বা সোনিয়ার স্বামী নন, এভাবেই লাখ লাখ প্রবাসী ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে দেশে স্বজনদের কাছে টাকা পাঠাচ্ছেন। আর এর নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বিকাশ একাউন্ট। ফলে সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা (রেমিট্যান্স)।
সিআইডি জানিয়েছে, হুন্ডি কারবারিরা বিদেশ থেকে দেশে অর্থ পাঠাতে নিত্য-নতুন কৌশল নিচ্ছে। অবৈধ উপায়ে দেশে অর্থ আনতে তারা এখন মোবাইল ব্যাংকিং বেছে নিয়েছেন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে আর্থিক লেনদেন বাড়লেও যেসব ব্যাংকে এই সেবা চালু আছে, তাদের রেমিট্যান্স প্রবাহও কমেছে। এতেই বোঝা যায়, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে না। তা সরাসরি হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে হুন্ডি বাণিজ্য বেড়ে যাওয়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহে ব্যাপকভাবে ধস নেমেছে। এতে শত কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। ফলে ডিজিটাল বাংলাদেশের অংশ হিসেবে চালু হওয়া মোবাইল ব্যাংকিং সেবাটি এখন কাঠগড়ায়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) অনলাইন জুয়াসহ বিভিন্ন অবৈধ লেনদেন সহজ করে দিয়েছে। অনলাইন জুয়া বাংলাদেশে ব্যাপক আকারে শুরু হওয়ার পর থেকে জুয়ার অ্যাপসে ইন্টারন্যাশনাল পেমেন্ট গেটওয়ের সঙ্গে আমাদের দেশের এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর নম্বর যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে জুয়া খেলতে প্রয়োজনীয় ভার্চুয়াল মুদ্রা যা চিপস, গোল্ড কয়েনসহ বিভিন্ন নামে পরিচিত এগুলো কেনা একেবারেই সহজ হয়ে গেছে।
সিআইডির এর কর্মকর্তা বলেন, বিকাশ এজেন্টরা কোনো ধরনের নিয়মের তোয়াক্কা না করে বার্তা অনুযায়ী কাঙ্খিত জায়গায় টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছে। এতে বিকাশের হিসাব ব্যবহার করছে। ফলে বিদেশ থেকে সরাসরি টাকা বাংলাদেশে না আসায় রেমিট্যান্স কমছে বাংলাদেশের। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যসহ লেনদেনে। এমন লেনদেন মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১৭ (সংশোধিত ২০১৬) এর ২ (ক) ও (২) ধারা অনুযায়ী অর্থ বা সম্পত্তি পাচারের পর্যায়ভুক্ত। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হয়েছে। আরও যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনটিতে মূলত এজেন্টদের নানা অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার উত্তরায় আবদুল মান্নানের ‘মোল্লা জেনারেল স্টোর’-এর নামে খোলা বিকাশের মার্চেন্ট হিসাবটি মো. মনিরের বিকাশ এজেন্ট পয়েন্ট এম আর লন্ড্রিতে ব্যবহার হচ্ছে। সেখানে কোনো ধরনের পণ্য বিক্রি না করে এজেন্ট পয়েন্টে ক্যাশআউট করতে আসা গ্রাহকের টাকা মার্চেন্ট হিসাবে নিয়ে বিধিবহির্ভূতভাবে লেনদেন করছে। একইভাবে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি রিয়াজউদ্দিন বাজারে আবদুল লতিফের ‘টু স্টার পোলট্রি অ্যান্ড সেলস সেন্টার’-এর নামে খোলা মার্চেন্ট হিসাবটি তার পাশের বিকাশ এজেন্ট পয়েন্ট ‘বায়েজিদ কুলিং কর্নার অ্যান্ড টেলিকমে’, ঢাকার আশুলিয়ার মোল্লা ডেকোরেটর অ্যান্ড টেলিকমের নামে খোলা বিকাশ মার্চেন্ট হিসাবটি বিকাশের এজেন্ট মো. রাজু আহাম্মেদ লেনদেন করেছেন। এসব বিকাশ এজেন্ট পয়েন্টে কোনো গ্রাহক ক্যাশআউট করতে এলে তার টাকা এজেন্ট হিসাবে ক্যাশআউট না করে মার্চেন্ট হিসাবে পেমেন্টের মাধ্যমে গ্রহণ করে। পরে যখন কোনো বিকাশ গ্রাহক টাকা পাঠানোর জন্য এসব বিকাশ এজেন্ট পয়েন্টে যান তখন বিকাশ এজেন্টরা মার্চেন্ট হিসাবের টাকা গ্রাহকের দেওয়া এজেন্ট নম্বরে মার্চেন্ট টু এজেন্ট (এম-টু-এ) স্থানান্তর করে। এ প্রক্রিয়ায় এজেন্ট হিসাব থেকে বিকাশ কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত মাশুল পায় না।