ক্লাস এইটের পর আর লেখাপড়া করেন নি টাঙ্গাইল জেলার তাওহীদুল ইসলাম। ভাগ্য পরিবর্তনের আশার চলে যান ওমানে। সেখানে গিয়ে ইংরেজি না জানার কারনে আরো বিপদে পরেন। সার্চ ইংলিশের কল্যানে তার জীবন বদলানোর সত্যি ঘটনা এখানে তুলে ধরা হল তারই কথায়)।
আমি তাওহীদুল ইসলাম। আমার বাসা টাঙ্গাইলে। আমি ওমানে থাকি। আজকে আপনাদের সাথে আমার জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করব যেটা হয়তো বা অনেকের কাজে লাগতে পারে। পড়াশুনা না করলে কতটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এই জন্যেই আমি আপনাদের সাথে আমার জীবনের গল্পটা শেয়ার করছি।
২০০৫ সালে আমি পড়াশুনা একেবারেই বন্ধ করে দেই। তখন থেকে আমার পড়াশুনা করা হয়নি। অষ্টম শ্রেণীতে উঠে আমি আর পড়াশুনা করিনি। ক্রিকেট, ক্রিকেট, আর ক্রিকেট। এই জিনিসটা নিয়েই আমি সারাদিন থাকতাম। আমার বাবা বাইরে থাকতেন। তো আমার বাবা অনেক চেষ্টা করেও আমাকে পড়াশুনার দিকে ফেরাতে পারেন নি। কোনভাবেই কাজ হয় নি। আমি কারোর কথা শুনিনি। এমন না যে পড়াশুনায় আমি খারাপ ছিলাম। আমি স্কুলে যাব না, পড়াশুনা করব না, আমার ভাল লাগে না বন্দী জীবন। বন্দী জীবন বলতে প্রতিদিন স্কুলে যেতে হচ্ছে তারপর আবার আসতে হচ্ছে সময় করে। এটা আমার ভাল লাগত না। চঞ্চলতা আমার ভাল লাগত।
তারপর এভাবে তিন চার বছর চলে গেল। আমার বাবাও চলে আসল। তখন বাবা চিন্তা করল আমাকে দিয়ে কি করান যায়। তিনি আমাকে, আমাদের স্থানীয় বাজারে একটা জুতার দোকান করে দিলেন। আমাদের গ্রামের বাজারটা অনেক জাঁকজমক হয়। সবকিছুই ঠিক ছিল, সবই চলছে।
তো আমি আমার দোকানে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিতাম। দেখা গেল যে দোকানে একজন ক্রেতা এসেছে বা কেউ এসেছে তার কাছে থেকে আমি বিক্রি বাবদ যে টাকা পাচ্ছি সেটাই আবার খরচ করে ফেলছি। এভাবে তিন-চার মাস পরে দোকান শেষ হয়ে গেল। আমাকে দিয়ে আর দোকান হবে না। দোকানের পিছনে তিন লক্ষ টাকার মতো খরচ হয়ে গিয়েছিল। ওখানে আমি প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা নষ্ট করে ফেলি। আমার বাবা এই দোকানের বাবদে মানুষের কাছে থেকে অনেক ধারদেনা করেছিলেন। সেই টাকাগুলো আর উঠে আসেনি। আমার বাবা অনেক কষ্ট পেলেন।
আবারো আমাকে নিয়ে সবার একটা দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে গেল, ছেলেটা কাজ করছে না। কি করবে জীবনে। আমি তো জীবনে কোন কিছুই করতে পারব না। না করেছি পড়াশুনা, না করেছি চাকরি, না করতে পেরেছি ব্যবসা। সবকিছুতেই আমি ব্যর্থ। ব্যর্থ বলতে এসব ক্ষেত্রে ব্যর্থ। কিন্তু ওই খেলাধুলা, গান এগুলো আমি খুবই ভাল পারি।
তো কোন একটা সময় পরিবারের সবাই মিলে আমাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিল। সবাই আবার ভয়ও করছিল যে যদি আমি বিদেশ থেকে চলে যাই। একদিন আমার চাচা, চাচাত চাচা যারা আছে উনাদের সবাইকে নিয়ে আমাদের বাসায় একটা মিটিং ডাকা হলো। তো সবার সামনেই আমাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, “তুমি কি বিদেশে যাবে? তুমি কি থাকবে সেখানে?
আমি অনেক সঙ্কোচ, ভয়, লজ্জা সবকিছু নিয়ে বললাম, ” আমি যাব। সমস্যা নেই।” আমি ঢাকা যাচ্ছি আর আসছি। ভাল একটা কোম্পানিতে যাওয়া যায় কিনা ভাল একটা কাজে। তো হঠাৎ একদিন এই কোম্পানির একটা ডেলিগেট ওমান থেকে আসল। তো আমাকে ডাকা হলো ওখানে। ডাকবার পরে জিজ্ঞাসা করা হলো তুমি কি পড়াশুনা করেছ? আমি তখন ওখানে সাথে সাথে উত্তর দিলাম আমি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছি। তো ওই ভদ্রলোক আমাকে বললেন, “যদি কখনো ডেলিগেট তোমাকে জিজ্ঞাসা করে যে তুমি কতটুকু পড়াশুনা করেছ বা তোমার ডেলিগেটের সাথে যে বাংলাদেশী অনুবাদক থাকবে উনি যখন জিজ্ঞাসা করবে তখন তুমি বলবে যে তুমি এস এস সি পাস করেছ।“ এই ব্যাপারটা আমাকে মানসিক কষ্ট দিয়েছিল। যে বিদেশে গিয়ে প্রথমেই আমাকে মিথ্যা কথা বলতে হবে। আমার প্রবাস জীবনের শুরুতেই। আমার কষ্ট ঐদিন থেকেই শুরু হয় যে আমাকে পড়াশুনা না করার জন্যে এখনি মিথ্যা কথা বলতে হচ্ছে।তো যাই হোক ওখানে যাবার পরে তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করে নি। ওরা আমাকে দেখল আমি একটু লম্বা, ভাল স্বাস্থ্য। এভাবেই আমাকে তারা নির্বাচন করল।
আমি ওমানে আসলাম ২০১৩ সালের ৩রা মে। এয়ারপোর্টে নামবার পরে আমি কিছুই বুঝি না। না পারি আরবি, না পারি ইংলিশ, না পারি হিন্দী। এখানে আরবী আর হিন্দীটা চলে বেশি। তো আমাকে আমার কোম্পানি রিসিভ করল। এখান থেকে আমাদের পাঠানো হল একটা পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। ওখানে আমার কাজ শুরু করলাম। আমার সাথে আরেকজন বাংলাদেশী ছিলেন। উনিও ভাষা পারেন না। আমিও পারি না। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আরবীটা আমি শিখে গেলাম। ওখানে আমার ইংরেজিটা এত বেশি প্রয়োজন ছিল না। আমি বুঝতে পারি নি ইংরেজি ভাষার মূল্য।
একসময়ে হঠাৎ আমাকে আমার উপরওয়ালা ডাকেন এবং জিজ্ঞাসা করেন যে তুমি কি আরবি ভাষা পার? আমি বললাম হ্যা, আমি আরবি পারি। তো উনি তখন আমাকে বললেন যে আমাকে একটা হোটেলে কাজ দেয়া হবে আমি সেখানে কাজ করতে পারব কিনা? একথা শুনে আমি তো খুবই খুশি। আমি বললাম হ্যা আমি কাজ করতে পারব। তো উনি আর জিজ্ঞাসা করেন নি যে এখানে ইংলিশ লাগবে কিনা। তারপরে সেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে হোটেলে পাঠান হয় আমাকে।
আমি হোটেলে আসলাম। এখানে আসার পর প্রথমদিন আমার যেটা হয়। প্রথমদিনে বস আমাকে বলল যে তোমাকে ভাউচার লিখতে হবে। কারণ তুমি ক্যাশ কাউন্টারে কাজ করবে। এ সময়টা আমার জন্যে ছিল খুবই কষ্টের। আমি কি লিখব? আমি তো সেভাবে লিখতে পারি না। তখন হোটেলে কাস্টমার নেই অফ সিজন চলছিল।
তো এখানে যে কাজ করত সে ছুটিতে যাবে এইজন্যে আমাকে অস্থায়ী ভাবে রেখে তারা পরীক্ষা করছে । তো তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি লিখতে পার?” তো আমি তখন দিনরাত ইংরেজিতে লেখা চর্চা করতাম। তো মোটামুটি ওই ভাউচার দেখে দেখেই লিখতাম। যাই হোক ওই চাকরিতে শর্ত ছিল লেখতে হবে। তো দেখে দেখে লেখা হতো। আমি ইউটিউবে সার্চ করে লেখা শিখতাম তখন। ইংরেজিটা লেখা একটু শিখে গেলাম।
জুলাই মাসে হোটেলে যখন সিজন আসে তখন মাদ্রাসা বন্ধ থাকে, স্কুল বন্ধ থাকে। স্কুল যখন বন্ধ থাকে তখন অনেক বেশি লোক আসে হোটেলে। অনেকে বাইরের দেশ থেকেও আসে এবং এসব লোকদের বড় অংশই ইংরেজিতে কথা বলত। তখন আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম যে আমি ইংরেজিতে কথা বলতে পারি না। কি বলব আমি কিছুই বুঝি না। আরবিতে বললে আমি সবই বুঝি কিন্তু যখনি ইংরেজিতে কিছু বলে তখন আমি সেটা না শোনার ভান করে অন্যদিকে কিছু একটা কাজে ব্যস্ত আছি এমন ভাব দেখাই। এই যে একটা লজ্জা। একবার তো একজন আমাকে বলেই ফেলল, “তুমি কি ইংরেজি পার না? তাহলে এখানে কেন কাজ করছ?”তো এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন আমি হয়েছি।
তো তখন থেকেই মনের ভেতর একটা কষ্ট ছিল যে আমি কেন পড়াশুনা করলাম না। আমি কিভাবে এখন ইংরেজি শিখব? তারপর ফেসবুকে খুঁজতে খুঁজতে আমি কোন এক সময়ে সার্চ ইংলিশ গ্রুপে যোগ দেই। আমি নিজেও জানি না কখন কিভাবে এই গ্রুপে যোগ দিয়েছি। তবে গ্রুপের পোস্টগুলো পড়তাম। কিন্তু প্রথম প্রথম আমি বুঝতে পারতাম না। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে গ্রুপে নিয়মিত সময় দেবার পরে হঠাৎ একদিন আমি রাতের বেলা শুয়েছিলাম। তখন লক্ষ করলাম যে ১২টার পরে Nisha Jahan আপুর পোস্ট। দিনটা ছিল ২৩ জানুয়ারি। তারপর উনার পোস্ট পড়ার পরে আমি এতটুকু বুঝলাম যে উনি অনেক কষ্ট করছেন। অনেক কম বয়সে উনার বিয়ে হয়েছে। উনার দুটো বাচ্চা আছে। উনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে পড়ছেন। তো এতটুকু বুঝবার পরে আমি শুরু করলাম।
পরদিন সকাল বেলা থেকে আমি ৩০টা কমেন্ট করা শুরু করলাম। ৩০টা কমেন্ট করার পরে আমি ভাবতে শুরু করলাম যে ৩০টা কমেন্ট আমার হচ্ছে না। আমি তো লিখতে পারছি Good, Go ahead, Thanks, এগুলো লিখতে পারছি। একটু একটু পড়তেও পারছি। কিন্তু আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে। তারপর দিন আমি ৭০ টার বেশি কমেন্ট লিখলাম। এরপরে সাতদিন চলে গেল। পরে ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে আমি আমার ইংরেজি স্পিকিং ভিডিও শুরু করি। আমি একটা পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম। সেখানে Razib Ahmed স্যার রিপ্লাইতে আমাকে ইংরেজিতে ভিডিও করা শুরু করতে বললেন। তিনি আরো বললেন যে আমি ভাল করব। তো ওই সময়ে রাতের বেলায় আমি প্রথম ভিডিওটা রেকর্ড করি। রাত ১২টার পরে ছাদে গিয়ে প্রথম ভিডিও রেকর্ড করার পরে গ্রুপে আপলোড করি এবং রাজিব স্যার কমেন্ট করেন, “ ভাল হচ্ছে। আপনি দেখে দেখে পড়ার ভিডিও করেন।“
পরের দিন আমি দেখে দেখে ইংরেজি রিডিং পড়ার ভিডিও আপলোড করতে শুরু করি। তো প্রথম জিরো ক্যাটেগরি থেকে শুরু করি। তখন আমি জিরো ক্যাটেগরির পোস্টগুলোও ঠিকমতো পড়তে পারতাম না। আমি প্রথম দেখে দেখে ইংরেজি পড়ার ১০০০ ভিডিও করেছি। ভিডিও করার আগে এমনিতেই আমি একবার পড়ে নিতাম যাতে আমার জন্যে সহজ হয়। এভাবে ২০০০ ভিডিও করে ফেলি। আমি রাতে ঘুম বাদ দিয়ে সবকিছু বাদ দিয়ে ছাদের উপরে বসে ভিডিও করতাম একটার পর একটা। এভাবে অনেক সময় চলে গিয়েছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে আমার ১০০০ ভিডিও শেষ করি। যে ১০০ জনের তালিকা তৈরি করা হয়েছিল যারা ১০০০ ভিডিও করেছে সেখানে আমি ছিলাম ৮৯তম। তারপর থেকে এভাবে গতকাল পর্যন্ত আমি প্রতিদিন ৩০টা কমেন্ট এবং রাজিব স্যারের যে রাইটিং প্রজেক্ট আছে সেখানে সময় দিয়ে আমি এখন পর্যন্ত আপনাদের দোয়ায় ১০ হাজার ভিডিও রেকর্ড করেছি।
আমি ইংরেজি শেখা শুরু করেছিলাম একদম শুন্য থেকে। আজকে আপনি আমার ইংরেজি কথা বলা শুনেছেন। এটা সম্পূর্ণ সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র সার্চ ইংলিশের কারণে। আর স্যারের গাইডলাইন অনুসরণ করার জন্যে। স্যারের গাইডলাইন আমি ১০০% অনুসরণ করেছি সেটা আমি কখনোই বলব না। কারণ স্যারের গাইডলাইন যদি আমি ১০০% অনুসরণ করতে পারতাম তাহলে আজকে আমি আরো ভাল কিছু করতে পারতাম। স্যারের গাইডলাইনের ৩০%-৪০% আমি অনুসরণ করেছি। আর সেই কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। আমি ইংরেজিতে এখন কথা বলতে পারছি।
আমি সার্চ ইংলিশ গ্রুপের গর্বিত একজন সদস্য। এই গ্রুপের সদস্য হতে পেরে আমার নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে। আর সারাজীবন আমি এটা বলে যাব আমি রাজিব আহমেদের ছাত্র। শুধুমাত্র তিনিই পেরেছেন আমার মতো একটা অগোছালো মানুষকে গুছিয়ে এভাবে গাইড করতে। আমার বাবা যখন এটা জানতে পারেন তিনি কেঁদে ফেলেন আমার জন্যে যে কিভাবে এটা সম্ভব হলো। যে ছেলেটাকে ১০০ মানুষ বুঝিয়েও কখনো লেখাপড়ার দিকে ফেরাতে পারে নি। একজন রাজিব আহমেদের কথায় কিভাবে সে পরিবর্তন হলো। আমার জন্যে এটা অনেক বড় একটা অর্জন।
এই মুহুর্তে যখন আমি আপনাদেরকে এই কথা গুলো বলছি তখন ভেতর থেকে আমি ভীষণ ভাবে আবেগতাড়িত হচ্ছি। সত্যি কথা বলতে আমি কিভাবে বলব না বলব সেটা বুঝতে পারছি না। কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারছি যে জীবনে কখনো আপনার মূল্যবান সময়টা নষ্ট করবেন না। এখন একটা সুযোগ আছে। হয়তো এমন একটা সময় আসবে যখন রাজিব স্যার থাকবেন না। কিংবা স্যার সময় দিতে পারবেন না। উনি সময় পাবেন না। তো সেদিন আমরা অনেক বেশি অনুভব করতে পারব স্যারের প্রয়োজনীয়তা কিভাবে উনি আমাদেরকে এই গ্রুপে আগলে রেখেছেন এবং কিভাবে শেখাচ্ছেন।
আপনি এখন যেটা বিনামূল্যে পাচ্ছেন এমন দিন আসবে যে আপনি টাকা দিয়েও এটা পাবেন না একটা সময়ে। তো সবার প্রতি আমার অনুরোধ। দোহাই আপনার! এখনো সময় আছে সিরিয়াস হন। এখান থেকে যদি আপনি কিছু না শিখতে পারেন তাহলে জীবনে আর কোথাও গিয়ে শিখতে পারবেন না।
সুত্রঃ https://www.facebook.com/groups/digitalskillsbd/permalink/448154919062632/