২০১৮-১৯ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) মাইক্রোসফটের রাজস্ব এক বছর আগের একই প্রান্তিকের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেড়ে ৩ হাজার ৬০ কোটি ডলার এবং নিট আয় ১৯ শতাংশ বেড়ে ৮৮০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। ক্লাউড, অফিস, উইন্ডোজ, এক্সবক্স, সার্চ বিজ্ঞাপন এবং সারফেস ডিভাইস ব্যবসায় উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধির সুবাদে প্রতিষ্ঠানটির আয় প্রত্যাশা ছাড়িয়েছে। গত মাসের শেষ দিকে তৃতীয় প্রান্তিকের আর্থিক খতিয়ান প্রকাশের পর মাইক্রোসফট করপোরেশনের শেয়ারপ্রতি দর ১৩০ দশমিক ৫০ ডলারে পৌঁছায়, যা এ-যাবত্কালের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর সুবাদে প্রথমবারের মতো ট্রিলিয়ন ডলার বাজারমূল্যের কোম্পানি ক্লাবে নাম ওঠে প্রতিষ্ঠানটির। মাইক্রোসফটের বাজারমূল্যে এমন উল্লম্ফনের কৃতিত্ব কার?
২০১৪ সালে মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) দায়িত্ব নিয়েছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত সত্য নাদেলা। তখন পার্সোনাল কম্পিউটার (পিসি) সফটওয়্যারকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানটি খুব খারাপ সময় পার করছিল। সিইওর দায়িত্ব নেয়ার পরই মাইক্রোসফটের ব্যবসা ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন সত্য নাদেলা। তার যুগোপযোগী কিছু পরিকল্পনা এবং উদ্যোগের কারণে ব্যবসার দিক থেকে খুব বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে হয়নি প্রতিষ্ঠানটিকে। ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনতে সত্য নাদেলার গৃহীত পদক্ষেপের কারণেই এখন ট্রিলিয়ন ডলার বাজারমূল্যের কোম্পানি ক্লাবে মাইক্রোসফটের নাম উঠেছে। অবশ্য এর আগে অ্যাপল ও অ্যামাজন ট্রিলিয়ন ডলার ক্লাবে নাম লেখাতে সক্ষম হয়েছে।
২০১৪ সালে সত্য নাদেলা যখন মাইক্রোসফটের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, তখন বৈশ্বিক হার্ডওয়্যার বাজারে পিছিয়ে থাকলেও মাইক্রোসফটের ব্যবসায় উল্লম্ফন ঘটতে শুরু করে। তিনি সিইওর দায়িত্ব নেয়ার পরই ক্লাউড কম্পিউটিং ব্যবসায় গুরুত্ব দেন। ক্লাউড প্রযুক্তি খাতে অ্যামাজনের বিপরীতে বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করে সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি। গত কয়েক বছর বহুজাতিক অন্য প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মতোই ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনতে জোর দিয়ে আসছেন সত্য নাদেলা। যে কারণে উইন্ডোজ, এক্সবক্স কনসোল ও সারফেস সিরিজের পণ্য থেকে প্রতিষ্ঠানটির রাজস্ব আয় বাড়ছে।
বিশ্বব্যাপী এখন ক্লাউড প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। সাধারণ ভোক্তা থেকে শুরু করে এন্টারপ্রাইজ পর্যায়ে ক্রমান্বয়ে ক্লাউড প্রযুক্তির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। এন্টারপ্রাইজ খাত ব্যবসায় প্রবৃদ্ধির জন্য ক্লাউড প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। ক্লাউড প্রযুক্তির কল্যাণে অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসায় দিক থেকে সাফল্যও পেয়েছে। গ্রাহক চাহিদা বাড়ায় মাইক্রোসফটের ক্লাউড প্রযুক্তি ব্যবসা বিভাগের রাজস্ব বাড়ছে।
সত্য নাদেলা তার বইয়ে লিখেছেন, স্মার্টফোন কিংবা পিসি মাইক্রোসফটের প্রধান ব্যবসা নয়। কীভাবে এ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির জন্য মুখ্য নয়, বইয়ে তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বইয়ে লিখেছেন, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আরো বেশি অর্জনে সহায়তা দেয়াই মাইক্রোসফটের প্রধান লক্ষ্য।
মাইক্রোসফট সিইওর ভাষ্যে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রূপান্তর হওয়া উচিত গ্রাহক চাহিদার ওপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ গ্রাহক কিছু চাওয়ার আগেই যাতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কাঙ্ক্ষিত পণ্য বা সেবাটি সরবরাহ করতে পারে। মাইক্রোসফটের কর্মীরা এই একটি বিষয় হূদয় থেকে গ্রহণ করেছেন। যে কারণে মাঝে টানা কয়েক বছর খারাপ সময় পার করলেও ব্যবসায় ঝুঁকি কাটিয়ে উঠতে পেরেছে মাইক্রোসফট।
সত্য নাদেলার আগে মাইক্রোসফটের সিইও ছিলেন স্টিভ বলমার। সে সময় প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারদর সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে। এরপর নাদেলা দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম বছরেই মাইক্রোসফটের শেয়ারদর বাড়ে ১৪ শতাংশ এবং দ্বিতীয় বছর শেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারদর আরো ২১ শতাংশ বাড়ে।
মোবাইল ডিভাইস হার্ডওয়্যার ব্যবসা নিয়ে বেশ আশাবাদী ছিল মাইক্রোসফট। এখানে ব্যবসা জোরদারে নকিয়ার হ্যান্ডসেট ব্যবসা বিভাগ অধিগ্রহণ করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু অ্যান্ড্রয়েডচালিত ডিভাইসের সঙ্গে ব্যবসা প্রতিযোগিতায় সুবিধা করতে পারেনি মাইক্রোসফট। নকিয়ার হ্যান্ডসেট ব্যবসা বিভাগ অধিগ্রহণ প্রতিষ্ঠানটির লোকসানি ব্যবসায় পরিণত হয়। শেষ পর্যন্ত বিভাগটি বিক্রি করে দেয় মাইক্রোসফট।
ভবিষ্যতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবসায় নতুন মাত্রা যোগ করবে। এমন আশাবাদ থেকে এআই নিয়ে কার্যক্রম জোরদার করেছে মাইক্রোসফট। এআই বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে পরিবর্তনশীল অনুষঙ্গ হবে বলে মনে করেন সত্য নাদেলা। সে অনুযায়ী এআই নিয়ে কার্যক্রম জোরদার করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
সত্য নাদেলা মাইক্রোসফটের সিইওর দায়িত্ব নেয়ার পর শুধু ক্লাউড কম্পিউটিং কিংবা এআই খাতেই নয়, চুক্তি ও অধিগ্রহণেও অধিক গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। এরই অংশ হিসেবে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির ওয়েবসাইট লিংকডইন অধিগ্রহণ করেছে মাইক্রোসফট। রাজস্ব বাড়াতে লিংকডইন ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। সত্য নাদেলার নেতৃত্বে গিটহাব নামে আরো একটি প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ করেছে মাইক্রোসফট। ডেভেলপার কমিউনিটিকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়ার একটি প্রতিষ্ঠান গিটহাব।
সত্য নাদেলার নেতৃত্বে ডেস্কটপের পাশাপাশি মোবাইল ডিভাইসের অ্যাপ বাজারেও ভালো করছে মাইক্রোসফট। মোবাইল প্লাটফর্মের জন্য এরই মধ্যে বেশকিছু অ্যাপ এনেছে মাইক্রোসফট। যেগুলো প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাপলের আইফোন অ্যাপের চেয়ে অনেকাংশে উন্নত এবং কার্যকর। বিশ্বব্যাপী এসব অ্যাপের ব্যবহারকারী কয়েক মিলিয়ন ছাড়িয়েছে।
রাজস্বে উল্লম্ফনের কারণে মাইক্রোসফট ট্রিলিয়ন ডলার ক্লাবে নাম লেখালেও এর নেপথ্যে প্রধান ভূমিকা রেখেছেন সত্য নাদেলা। বাজারমূল্যে বিশ্বের প্রথম ট্রিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করে অ্যাপল। এরপর অ্যামাজনও ট্রিলিয়ন ডলার ক্লাবে নাম লেখায়। তৃতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাইক্রোসফট একই মাইলফলক স্পর্শ করেছে। অবশ্য আইফোন ব্যবসা নিয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে থাকা অ্যাপল এরই মধ্যে ট্রিলিয়ন ডলার ক্লাব থেকে ছিটকে পড়েছে।