তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ এবং এর আওতাধীন বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থা থেকে পাওয়া যায় এমন কোন সুবিধা বাদ দেননি ‘সাইবার টিনস’ এর প্রতিষ্ঠাতা সাদাত রহমান। বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের থেকে অফিস বরাদ্দ, আইডিয়া প্রকল্প থেকে আর্থিক অনুদান, এসপায়ার টু ইনোভেটের (এটুআই) মাধ্যমে সরকারি ডোমেইনের ওয়েবসাইট, বিজ্ঞাপনের জন্য অর্থায়ন প্রাপ্তিসহ নিজের বিদেশ ভ্রমণ এবং বাবার ঢাকায় বদলির মত সুবিধা নিয়েছেন তিনি। সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সাহচর্য্যে সরকারি এসব সুবিধা বাগিয়েছেন সাদাত রহমান। ছাত্র-জনতার আন্দোলনেও তার ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
সাইবার টিনসের ওয়েবসাইট মতে, ‘সাইবার টিনস’ নামক একটি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে ২০১৯ সালে যাত্রা শুরু প্ল্যাটফর্মটির। উদ্দেশ্য হলো ভার্চুয়াল জগতে সাইবার বুলিং এবং অপরাধের শিকার শিশু-কিশোরদের সহায়তা প্রদান এবং প্রয়োজনে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সাথে তাদের যোগাযোগ স্থাপন। একই বছর ‘কিডস-রাইটস’ নামের একটি সংগঠন থেকে নেদারল্যান্ডসে আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার পান সাদাত। মাত্র ১৭ বছর বয়সের এমন অর্জনে পাওয়া খ্যাতিতে সেসময়ের আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং প্রভাবশালী আমলাদের সাথে দ্রুতই সখ্যতা বাড়ে তার। তারই ধারবাহিকতায় তৎকালীন আইসিটি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী পলকের আশীর্বাদে অন্তত আধা ডজন সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন সাদাত। শুরুটা হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে যশোর হাইটেক পার্কে অফিস স্থান বরাদ্দের মাধ্যমে। পরবর্তীটে বাগিয়ে নেন রাজধানীর কাওরান বাজারের ‘ভিশন-২০২১ টাওয়ার-১’ সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে অফিস স্পেস। অবকাঠামো দুটির স্টার্টআপ ফ্লোরে বিনা ভাড়ায় সেই স্পেস বরাদ্দ দেওয়া হয়। অথচ সাইবার টিনসকে ‘অলাভজনক প্রতিষ্ঠান’ দাবি করেন সাদাত।
বরাদ্দ সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা পরিচয় গোপনের শর্তে টেকজুমকে বলেন, সাইবার টিনস’কে স্পেস বরাদ্দ দিতে সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলকের জোর সুপারিশ ছিল। তাদের থেকে ভাড়া না নিতে পলকের আদেশে স্টার্টআপ ফ্লোরে বরাদ্দ দেওয়া হয়।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) বাস্তবায়নধীন ‘আইডিয়া’ প্রকল্প থেকে ৩ লাখ টাকা অনুদান পায় সাইবার টিনস। এক লিখিত বক্তব্যে আইডিয়া প্রকল্প কার্যালয় থেকে জানানো হয়, সাইবার টিনসের প্ল্যাটফর্ম (cyberteens.gov.bd) ডেভেলপের জন্য এই অর্থ খরচ করেছে সাইবার টিনস। তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এবং সরকারি অর্থে প্ল্যাটফর্মটি ডেভেলপমেন্ট করে আইসিটি বিভাগের আরেক সংস্থা এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই)। আইডিয়া প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক আনোয়ার হোসেন টেকজুমকে বলেন, সেসময় প্রকল্প পরিচালক ছিলাম না। আইডিয়া প্রকল্প থেকে সাধারণত স্টার্টআপ’দের অনুদান দেওয়া হয়, ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। সাইবার টিনস স্টার্টআপ না হলেও, ‘সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট’ রাখতে পারে এমন কারণে অনুদান দেওয়া হতে পারে। তবে প্রকল্পের এক কর্মকর্তা বলেন, অদ্যবধি মাত্র দুইটি প্ল্যাটফর্মকে ‘সামাজিক প্রভাব’ কারণ দেখিয়ে অনুদান দেওয়া হয়েছে। সাইবার টিনস ছাড়া অপরটি হচ্ছে ‘থার্ড জেন্ডার’। সাইবার টিনসকে অনুদান দিতে পলকের মৌখিক নির্দেশনা ছিল।
সাদাত রহমানের বিরুদ্ধে আরও বড় অভিযোগ ‘ডট গভ ডট বিডি’ তথা সরকারি ডোমেইনের ওয়েবসাইট ব্যবহারের। ‘cyberteens.gov.bd’ নামের ওয়েবসাইটটিতে কনটেন্ট প্রকাশের নিয়ন্ত্রণ সাদাত রহমান ও তার দলের দখলে। ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব কনটেন্টও সাইবার টিনস তথা সাদাতের। এই ডোমেইন ও ওয়েবসাইট কে, কার জন্য বানিয়েছে এবং কে ব্যবহার করছে এ নিয়ে রয়েছে ব্যাপক ধোঁয়াশা। যদিও সাইবার টিনস একটি বেসরকারি ফাউন্ডেশন হওয়ায় সরকারি ডোমেইন ব্যবহারের সুযোগ নেই। অনুসন্ধানে জানা যায়, এধরনের ডোমেইন ইস্যু করে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। সাইবার টিনসের ডোমেইন বিশ্লেষণে দেখা যায়,গত বছরের ৩ ডিসেম্বর এটি সক্রিয় হয়।
এটুআই ডোমেইনটির নিবন্ধনকারী।
বিটিসিলের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা টেকজুমকে বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের বাইরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এমন ডোমেইন দেওয়া হয় না। যখন কোন সরকারি প্রতিষ্ঠান ডট গভ ডট বিডি ডোমেইন চায়, তখন সেটি ইস্যু করি। সেভাবেই এটুআই থেকে এই ডোমেইন ইস্যু করতে বিটিসিএল’কে বলা হয়েছিল। আইসিটি বিভাগের আদেশে ডোমেইনটি ইস্যু করা হয়েছিল বলে জানান এটুআই এর প্রকল্প পরিচালক মামুনুর রশীদ ভূইয়া বলেন, ওয়েবসাইট আগেই ছিল। আইসিটি বিভাগের আদেশে শুধু ডট গভ ডট বিডি ডোমেইনটি নেওয়া হয়েছে। কেন কী কারণে ডোমেইনটি নিতে বলা হয়েছিল, জানা নেই। তবে সংস্থাটির উচ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা পরিচয় গোপনের শর্তে বলেন, চাপ প্রয়োগ করে এটুআই’কে দিয়ে ডোমেইন করিয়েছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলক। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা আপত্তি তুললেও পলকের চাপে ডোমেইন নিতে বাধ্য হন তিনি।
শুধু তাই নয়, সাইবার টিনস এর পুরনো ওয়েবসাইট cyberteensfoundation.org সংযুক্ত করা হয়েছে সরকারি ডোমেইনের ওয়েবসাইটের সাথে। ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে ‘হোম’ এ ক্লিক করলে ব্যবহারকারী পৌছাবেন সরকারি ওয়েবসাইটে। পাশাপাশি ফেসবুকে সাইবার টিনসের পেজেও ওয়েবসাইট হিসেবে সরকারি ওয়েবসাইটটির উল্লেখ রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সাইবার টিনসের প্রাতিষ্ঠানিক এবং সাদাত রহমানের ব্যক্তিগত প্রভাব জাহির করতেই সরকারি ওয়েবসাইট নিয়েছেন তিনি।
আইসিটি বিভাগের আরেক সংস্থা ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টার থেকে টিভি বিজ্ঞাপন প্রস্তুত বাবদ ৫ লাখ টাকা নিয়েছে সাইবার টিনস। আরও ৩ লাখ টাকা যোগ করে মোট ৮ লাখ টাকায় বিজ্ঞাপন বানিয়েছেন। তবে সেই বিজ্ঞাপন টিভিতে প্রচারের কোন বাজেট বা পূর্ব পরিকল্পনা প্রস্তুত হয়নি। ফলে টাকাগুলো অনর্থক খরচ হয়। পাশাপাশি টিভিতে প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে বানানো সেই বিজ্ঞাপন পড়ে রয়েছে শুধু সাইবার টিনসের ওয়েবসাইটে।
ব্যক্তিগতভাবেও পলকের থেকে সুবিধা পেয়েছেন সাদাত। ২০২২ সালের মে’তে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে আইসিটি বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত ‘গোল্ডেন জুবিলি বাংলাদেশ কনসার্ট’ এ পলকের সফরসঙ্গী ছিলেন সাদাত। কোন সরকারি পদে না থেকেও রাষ্ট্রীয় অর্থে বিদেশ যান সাদাত। যে উদ্দেশ্যে তাকে নেওয়া হয় সেই উদ্দেশ্যও পরবর্তীতে আর বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে একরকম জলেই যায় দেশের টাকা।
অন্যদিকে, পলকের সাথে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে সরকারি চাকরীজীবি বাবা সাখাওয়াত হোসেনকে ঢাকায় বদলি করান সাদাত। তিনি তখন কুষ্টিয়ার ডাকঘরের প্রধান ছিলেন।
বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ে সাদাত রহমানের ভূমিকা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। শিশু কিশোরদের নিয়ে কাজ করলেও, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় নিরব ছিলেন সাদাত। তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে ১৪ মে এরপর থেকে প্রকাশ করা সব পোস্ট সরিয়েছেন। অভ্যুত্থানের পর গত ৮ আগস্ট এক ভিডিও বার্তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ফেরেন সাদাত। সেখানে দাবি করেন, সাইবার টিনস প্ল্যাটফর্ম বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় সরাসরি ও প্রকাশ্যে ছাত্রদের পক্ষে কোন অবস্থান নেননি তিনি। তবে আন্দোলনের সময় সাদাত ছাত্র-জনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পোস্ট করেছিলেন বলেই সেগুলো সরাতে হয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযোগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের।