অবৈধ নকল এবং রিকন্ডিশনের দাপটে বৈধ ও আসল মোবাইল ফোন নিয়ে চ্যালেঞ্জে পড়েছেন স্থানীয়ভাবে মোবাইল ফোন কারখানা স্থাপনকারীরা।দেশের মোট মোবাইল-হ্যান্ডসেটের বাজারের ৪০ শতাংশই ইতোমধ্যে অবৈধ-নকল হ্যান্ডসেটের দখলে চলে গেছে। এতে নিজেদের বিনিয়োগ ও ব্যবসা ঝুঁকিতে পড়ার পাশাপাশি চলতি অর্থবছরে সরকারও প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাবে বলে আশংকার কথা জানিয়েছে মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এমআইওবি)।
দেশে মোবাইল ফোনের বাজার প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার। এ শিল্পে সরাসরি তিন থেকে চার লাখ মানুষ জড়িত। ২০১৮ সালের আগে বাংলাদেশে শতভাগ মোবাইল ফোন বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। কিন্তু সরকারি প্রণোদনায় ২০১৮ সাল থেকে দেশে একের পর এক মোবাইল কারখানা স্থাপিত হতে থাকে। এ পর্যন্ত দেশি-বিদেশি ১৭টি মোবাইল ফোন কারখানা দেশে স্থাপিত হয়েছে।
দেশের চাহিদার প্রায় ৯৯ শতাংশ ফোনই এখন দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। কিন্তু অবৈধভাবে ফোন আমদানি বন্ধ না করায় স্থানীয় বাজারের প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ এখন চোরাই ফোনের দখলে। তৈরি ফোন আমদানিতে যেখানে প্রায় ৫৮ শতাংশ কর রয়েছে, সেখানে এসব ফোন বিনা শুল্কে বাজারজাত হচ্ছে। ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন শতশত কোটি টাকা ব্যয় করে কারখানা স্থাপন করা ব্যবসায়ীরা।
দেশে ১৭টি কারখানায় বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। এসব কারখানায় দক্ষ শ্রমিক ২৫ হাজারের বেশি। পরোক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে আরও প্রায় ৫০ হাজার লোকের। সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠার। ফোন প্রস্তুতকারকদের সংগঠন, মোবাইল ফোন অপারেটর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সব অংশীজনের সঙ্গে কয়েক বছরের পর্যালোচনা শেষে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ২০২১ সালে এনইআইআর চালু করে। এ সিস্টেমের মাধ্যমে কার্যকরভাবে মোবাইল ফোনের অবৈধ আমদানি ও বিক্রয় রোধ করা সম্ভব । এনইআইআর সিস্টেম চালুর মাধ্যমে অবৈধভাবে ও কর ফাঁকি দিয়ে মোবাইল ফোনের আমদানি বন্ধ করা হবে, এ আশ্বাসের ভিত্তিতেই দেশের প্রধান প্রধান মোবাইল আমদানিকারকরা স্থানীয়ভাবে কারখানা স্থাপন করেছিলেন। ২০২০ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিপুল সরকারি অর্থ ব্যয় করে এনইআইআর সিস্টেমটি কেনে এবং স্থাপন করে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের এনইআইআর চালুর কিছুদিনের মধ্যেই তা স্থগিত বা শিথিল করে দেওয়া হয়।
বর্তমানে মোবাইল ফোনের বাজারের প্রায় ৪০ শতাংশ দখল করে আছে অবৈধভাবে আমদানি করা হ্যান্ডসেট। এসবের ওপর সরকার কোনো রাজস্ব আদায় করতে পারছে না। বর্তমান অর্থবছরে সরকার এ খাত থেকে দুই হাজার কোটি টাকার সম্ভাব্য রাজস্ব হারাবে।
এনইআইআর সিস্টেম শিথিল করে দেওয়ায় ফোন কারখানাগুলোর বিনিয়োগ এখন হুমকির মুখে। কারণ অবৈধভাবে দেশে আসা হ্যান্ডসেটের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কঠিন, তারা কর ফাঁকি দেয়। বৈধ ফোন তৈরির কারখানাগুলোর জন্য রয়েছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের নানা রকমের নিয়ম-নীতি, বিধি-নিষেধ, উচ্চ লাইসেন্স ফি। অথচ অবৈধ ফোনের ক্ষেত্রে কমিশনের কোনো নিয়ম-নীতিই প্রযোজ্য নয়।
এনইআইআর সিস্টেম শিথিল করার ফলে সরকার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। গ্রাহক নিম্নমানের হ্যান্ডসেট কিনে প্রতারিত হচ্ছেন, তা ছাড়া অবৈধ মোবাইলের কোনো ওয়ারেন্টি নেই। অবৈধভাবে আমদানি করা মোবাইল ফোন দিয়ে নানারকম অপরাধ সংগঠিত হয়। এনইআইআর চালু করার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো এসব অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করা।
বর্তমানে সন্ত্রাসীরা সিমকার্ড ছাড়া ওয়াই-ফাই বা অন্য কোনো প্রযুক্তির মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম। যদি মুঠোফোনের আইএমইআই নম্বরটি সিমের সঙ্গে রেজিস্ট্রি করা থাকে, তবে আইপি অ্যাড্রেস ও আইএমইআইর মাধ্যমে এ সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা সম্ভব। এনইআইআর পদ্ধতি এ নিরাপত্তা খুব সহজেই প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
অবৈধভাবে আমদানি করা হ্যান্ডসেটের মান পরীক্ষা হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভোক্তা সঠিক পণ্য পান না এবং অনেক ক্ষেত্রেই পূর্বব্যবহৃত পণ্য নতুন বলে বিক্রয় করা হয় যা টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের নীতিমালা পরিপন্থী। অবৈধভাবে আমদানি করা হ্যান্ডসেটের কোনো পরিসংখ্যান কমিশনের ডাটাবেজে নেই। যদি ভোক্তার এনআইডির অধীনে মুঠোফোন রেজিস্ট্রি করা থাকে, সেক্ষেত্রে অন্য কেউ বেআইনিভাবে তা ব্যবহার করবে না এবং হ্যান্ডসেট চুরি, ছিনতাই অনেকটাই নিরুৎসাহিত হবে। তদুপরি বিভিন্ন হয়রানিমূলক কাজও বন্ধ হবে।
রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্ক, রাইফেল স্কয়ার, ইস্টার্ন প্লাজা ও মোতালেব প্লাজাসহ বিভিন্ন অভিজাত শপিং মলে অসংখ্য দোকান রয়েছে শুধু এই অবৈধ ও নকল ফোনের যোগানের উপর ভিত্তি করে।
এছাড়া ফেইসবুকে পেইজ খুলে বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে ব্যাপকহারে এসব ফোন বিক্রি হচ্ছে। কয়েকভাবে এই অবৈধ ও নকল বাজার চলছে। থার্ড পার্টি রপ্তানিকারক ও আন্তর্জাতিক ডিস্ট্রিবিউরদের মাধ্যমে নির্ধারিত দামের কম মূল্য দেখিয়ে দেশে পণ্য আনা। দামি হ্যান্ডসেটগুলো কয়েকটি অংশে খুলে ব্যাপক পরিমাণে যংন্ত্রাংশ হিসেবে এনে এখানে লাগিয়ে বাজারে দেয়া। একইভাবে বিদেশে কয়েকমাস ব্যবহার করা হ্যান্ডসেট এনে এখানে একদম নতুনের মতো করে বিক্রি করা।এছাড়া কেজি হিসেবে যন্ত্রাংশ এনে এখানে ক্লোন ও নকল ফোন তৈরি করে বাজারে ছড়িয়ে দেয়া।