সরকারি চাকুরিতে অসম কোটা সিস্টেমের প্রতিবাদে আন্দোলন করেন বৈষম্য বিরোধী শিক্ষার্থীরা। যে বিসিএস তথা সরকারি চাকুরি সবার কাছে সোনার হরিণ সেই চাকুরি ছেড়েই আইসিটি বিভাগের কনসালটেন্ট হিসেবে চলে আসেন পলকের বাল্যবন্ধু ও সাবেক পিএস আব্দুল বারী ওরফে তুষার। এর আগেও তিনি আইসিটি বিভাগের আরেকটি প্রকল্পে লিয়েনের মাধ্যমে কনসালটেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
বিসিএস কর ক্যাডারের এই কর্মকর্তা বারংবার লিয়েনে আইসিটি বিভাগে আসতে চাওয়াই শেষ পর্যন্ত এনবিআর লিয়েন নামঞ্জুর করে দেয়। তখন চাকুরী ছেড়েই আইসিটিতে চলে আসেন পলকের বন্ধু আব্দুল বারী। বর্তমানে তিনি কম্পিউটার কাউন্সিলের এজ প্রকল্পে কর্মরত আছেন।
সরকারি চাকরিতে স্থায়ীভাবে কর্মরত কর্মচারিরা বৈদেশিক বা বেসরকারি চাকরি করতে চাইলে লিয়েন গ্রহণ করতে হয়। লিয়েন গ্রহণ করতে হলে বৈদেশিক বা বেসরকারি চাকরি গ্রহণের পূর্বেই অনুমোদনের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করতে হয়। পৃথক বৈদেশিক বা বেসরকারি চাকরির জন্য সরকারের থেকে পৃথক লিয়েন অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু এই শর্ত ভঙ্গ করে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের একটি প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে চুক্তি করেছিলেন রাজস্ব বোর্ডের লার্জ ট্যাক্সপেয়ার ইউনিটের (এলপিইউ) উপ-কর কমিশনার আব্দুল বারি। তিনি সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সাবেক একান্ত সহকারি (পিএস)।
বিসিএস কর ক্যাডারের কর্মকর্তা আব্দুল বারি লিয়েনের পূর্বে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উপ কর কমিশনার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ২০২১ সালে আইসিটি বিভাগের আওতাধীন বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ডিড প্রকল্পে ইনোভেশন স্পেশালিস্ট পদে আবেদনের জন্য লিয়েন অনুমতি নেন। সে বছরের ৩ অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের ২ অক্টোবর অথবা সেই পদে যোগদানের তারিখ থেকে পরবর্তী দুই বছরের জন্য লিয়েন অনুমতি নিয়েছিলেন আব্দুল বারি। তবে ২০২৩ সালের মার্চে এই পদ থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেন তিনি এবং একই বছরের ১৩ এপ্রিল আব্দুল বারিকে অব্যাহতি প্রদান করে আইসিটি বিভাগের বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ।
তবে আগের পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার আগেই বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আইসিটি বিভাগের ‘এনহ্যান্সিং ডিজিটাল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমি (এজ)’ শীর্ষক প্রকল্পে ‘পলিসি এডভাইজর অ্যান্ড কম্পোনেন্ট লিডার’ হিসেবে চুক্তিভিত্তিক পরামর্শক হন তিনি। ৪২ মাসের চুক্তিতে মাসিক ৫ লাখ টাকা বেতন হিসেবে মোট ২ কোটি ১০ লাখ টাকা পরামর্শক হিসেবে নেবেন আব্দুল বারি। তবে এজ প্রকল্পের পরিচালকের সাথে এই চুক্তি করার পূর্বে এবার আর সরকারের অনুমতি নেননি এই কর্মকর্তা।
বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, মোট ১ লাখ ৯৮ হাজার ৩৭৫ মার্কিন ডলার মূল্যে বা ২ কোটি ১০ লাখ টাকা মূল্যে চলতি বছরের ৪ এপ্রিল এজ প্রকল্পের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন আব্দুল বারি, যার চুক্তি নম্বর ১৭২৪৬৯৯। পাশাপাশি এজ প্রকল্পের তৎকালীন পরিচালক ড. মোহাম্মদ মেহেদি হাসানের সাথে আব্দুল বারির স্বাক্ষরিত এই চুক্তিপত্রের একটি কপি রয়েছে কাছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে প্রকল্পের বিভিন্ন কাজে নিজেকে সম্পৃক্তও রেখেছিলেন এই কর্মকর্তা। চুক্তিপত্র থেকে জানা যায়, আব্দুল বারির মাসিক বেতন ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এর সাথে অগ্রিম আয়কর হিসেবে মাসিক ৫০ হাজার টাকা পাবেন তিনি। সেই হিসেবে প্রতিমাসে ৫ লাখ এবং ৪২ মাসে মোট দুই কোটি ১০ লাখ টাকা বেতন নেবেন আব্দুল বারি। এর বাইরে অফিসের প্রয়োজনে যাতায়াত, বাসস্থান, টেলিফোন, প্রিন্টিং ব্যয়ের খরচও পাবেন তিনি।
এদিকে এই পরামর্শক ফি এর ওপর কোন ভ্যাটও দিতে হবে না আব্দুল বারিকে। আব্দুল বারির লিংকড ইন আইডি’তে দেখা যায়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবান প্লানিং এ স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। এরপর অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড থেকে ডাটা সায়েন্স বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি করেন। তবে এজ প্রকল্পে কোন আইটি বিশেষজ্ঞ নয় বরং নীতিনির্ধারণী পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন আব্দুল বারি। আইটি বিষয়ক কোন পদে না থাকলেও, আইটি বিশেষজ্ঞদের ভ্যাট মওকুফে দেওয়া রাজস্ব বোর্ডের সুবিধাও চুক্তিতে দেওয়া হয়েছে তাকে।
সরকারের থেকে লিয়েন অনুমতি না নিয়েই এজ প্রকল্পের ‘পলিসি এডভাইজার’ পরিচয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন আব্দুল বারি। ওই সময় কোনো কোনো অনুষ্ঠানে আবার বক্তা হিসেবেও যোগ দিয়েছেন তিনি। গত বছরের ১৩ জুন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, জাতিসংঘের এস্ক্যাপ এবং ইউএনডিপি’র যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত একটি ওয়েবিনারে ‘স্পিকার’ হিসেবে অংশ নেন তিনি। সেখানে আব্দুল বারি নিজেকে ‘পলিসি এডভাইসার, এজ প্রজেক্ট, আইসিটি ডিভিশন’ হিসেবে পরিচয় দেন। একই মাসের ২৩ তারিখ কক্সবাজারের একটি বিলাসবহুল হোটেলে এজ প্রকল্প কর্তৃক আয়োজিত সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক একটি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমেও অংশ নেন আব্দুল বারি। সেই প্রশিক্ষণের উপস্থিতি তালিকার একটি কপি রয়েছে কাছে, যেখানে তিনি তার নামের পাশে ‘পলিসি এডভাইজার, এজ’ উল্লেখিত পদবীর পাশের ঘরে উপস্থিতি স্বাক্ষর দেন।
আব্দুল বারির সরকারি কর্মস্থল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বোর্ডের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, তাকে আমরা প্রথম কাজের লিয়েন দিয়েছিলাম কিন্তু পরের বার লিয়েন দেইনি। সে লিয়েন নেয়ার জন্য তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী পলকের মাধ্যমে ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করেন। কিন্তু এনবিআর সে সময় লিয়েন অনুমোদন না করে তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে সংযুক্ত রাখেন। এরপরেও আব্দুল বারী বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করলে তাকে রংপুরের উপ কর কমিশনার হিসেবে বদলি করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে তিনি চেয়ারম্যানের কাছে সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে পদত্যাগ পত্র দিয়ে আইসিটি বিভাগে একেবারে চলে যান।
আব্দুল বারি লিয়েন অনুমতি না নিয়েই অন্য আরেকটি সংস্থায় কাজ করছেন এবং নিজেকে এজ প্রকল্পের পলিসি এডভাইসার পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে রাজস্ব বোর্ডের ঐ কর্মকর্তা বলেন, এমনটা করে থাকলে সে তার নিজ দায়িত্বে করেছেন। এর দায় তাকেই নিতে হবে।
আব্দুল বারির এজ প্রকল্পের পলিসি এডভাইজার পরিচয় ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে এজ প্রকল্পের সাবেক পরিচালক, বর্তমানে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে কর্মরত নাহিদ সুলতানা মল্লিক বলেন, শুরুতে উনি সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদের পিএস হিসেবে কর্মরত ছিলেন। উনার কাছাকাছিই থাকতেন। পরে হঠাৎ করে তিনি একদিন বললেন ম্যাডাম আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। এরপর শুনলাম তিনি আইসিটি বিভাগের একটি প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। শুরুতে তার লিয়েন থাকলেও পরে তা ছিলো বলেই জানতাম।
এনবিআর এর একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে, আব্দুল বারি এনহ্যান্সিং ডিজিটাল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমি (এজ)’ শীর্ষক প্রকল্পে লিয়েন মঞ্জুরের জন্য উচ্চমহল দিয়ে অনেক তদবীর করেছেন। কিন্তু তার এই দাবী কর্তৃপক্ষ যৌক্তিক মনে না করায় তারা লিয়েন মঞ্জুর করেনি। লিয়েনে যাওয়ার অনুমতি না দিয়ে উল্টো এনবিআর কর্তৃপক্ষ তাকে রংপুরে বদলী করেছিলো বলে সূত্রটি নিশ্চত করে। লিয়েন মঞ্জুরের জেরে একজন বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা পদত্যাগ করায় সূত্রটি বিস্ময় প্রকাশ করে সূত্রটি বলছে, তদবীর করে সফল না হওয়ায় কর্তৃপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করতেই আব্দুল বারী পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছিলেন কিন্তু তা কাজে লাগেনি।
এদিকে আইসিটি বিভাগের একটি সূত্র পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানিয়েছে, আব্দুল বারি এর আগেও আইসিটি বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে তিনি পরামর্শক হিসেবে যোগদান করলেও বিভিন্ন প্রকল্পের কোটি কোটি টাকার কাজ পছন্দের ঠিকাদারদের পাইয়ে দিতে কাজ করেন। কিছু কিছু প্রকল্পে তিনি প্রকল্প পরিচালক (পিডি) এর চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান বলে সূত্রটি অভিযোগ করেছে। এনবিআর এর একজন ক্যাডার অফিসার হলেও তিনি নিজ প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আইসিটি বিভাগে কাজ করতে বেশি আগ্রহী বলে তার কর্মকাণ্ডে বোঝা যায়। তার স্ত্রী ড. সিরাত মাহমুদা প্রশাসন ক্যাডারের একজন উপসচিব। তিনিও দীর্ঘদিন পলকের আশীর্বাদে আইসিটি বিভাগে কর্মরত ছিলেন বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।
লিয়েন সংক্রান্ত সরকারি চাকরির বিভিন্ন বিধি ও আইন থেকে জানা যায়, সরকারি পদের বাইরে গিয়ে কোনো বৈদেশিক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে লিয়েনের জন্য আবেদন করতে হবে। সরকারি কর্মচারী লিয়েন বিধিমালা, ২০২১ এর ১১ (চ) বিধি অনুযায়ী, লিয়েনের আবেদন মঞ্জুর না হওয়া পর্যন্ত কোন সরকারি কর্মচারী চাকরিতে অনুপস্থিত থাকতে পারবেন না, বা কোন বৈদেশিক বা বেসরকারি চাকরিতে যোগদান করতে পারবেন না। পাশাপাশি বৈদেশিক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রতিটি কাজে নিয়োগের পূর্বে সরকারের থেকে লিয়েন অনুমতি নিতে হয়।
এবিষয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন, একজন কর্মকর্তা যতোবার কোনো বৈদেশিক বা বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতে চাইবেন, তাকে ততোবার লিয়েন অনুমতি নিতে হবে। একটি কাজ শেষ হওয়ার পর তাকে তার মূল কর্মস্থলে ফিরে যেতে হবে এবং পরবর্তী কাজের জন্য আবার লিয়েন অনুমতির আবেদন করতে হবে। লিয়েন অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত সে কোন চুক্তিও করতে পারবে না। কেউ যদি বলে যে, সে শুধু চুক্তি করেছে, কাজে যোগ দেয়নি; সেটিও আইনত ঠিক নয়।
প্রথমে লিয়েন ছাড়াই পরামর্শক হিসেবে চুক্তি ও পরে বিসিএস চাকুরি ছেড়ে দেয়া এবং বন্ধু পলকের সাবেক পিএস হিসেবে প্রভাব বিস্তার করে টেন্ডার বাণিজ্য করার বিষয়ে আব্দুল বারিকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
আইসিটি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন এখানে কি এমন আছে যে তিনি বিসিএসের চাকরি ছেড়ে এই সেক্টরে যোগদান করেছেন। সীমাহীন দূর্নীতি আর অর্থ লুটপাটের জন্যই তিনি বিসিএসের চাকরি ছেড়ে আইসিটি সেক্টরে যোগ দিয়েছেন বলে মনে করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা। পলকের বন্ধু ও সাবেক পিএস হওয়ায় সচিব, বর্তমান পিএস ও অন্যান্য সিনিয়র কর্মকর্তাদের কেয়ার করতেন না আব্দুল বারী। তিনি পছন্দের কিছু মানুষ নিয়ে টেন্ডার বাণিজ্যের একটা সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন।