গবেষকরা এমন এক যুগান্তকারী সেমিকন্ডাক্টর চিপ উদ্ভাবন করেছেন, যা একই সময়ে ইলেকট্রনিক ও ফটোনিক উভয় ফাংশনেই কাজ করতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রের ‘কর্নেল ইউনিভার্সিটি’ ও পোল্যান্ডের ‘পোলিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস’-এর গবেষকরা যৌথভাবে এ প্রকল্পে কাজ করেছেন।
এ ‘ডুয়ালট্রনিক’ চিপ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের নকশাতেও বিপ্লব বয়ে আনার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে, যেখানে চিপ উৎপাদনের খরচ ও আকার কমানোর পাশাপাশি আরও দক্ষ উপায়ে বিদ্যুৎ খরচের সুযোগ মিলবে। ২৫ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল নেচার-এ প্রকাশ পেয়েছে গবেষণাটি।
এ উদ্ভাবনের মূল উপাদান হল ‘গ্যালিয়াম নাইট্রাইড’ (GaN), যা এরইমধ্যে উচ্চ কম্পাংকের ইলেকট্রনিক ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী এলইডি লাইটিংয়ে ব্যবহার করা সেমিকন্ডাক্টর হিসেবে পরিচিত।
গ্যালিয়াম নাইট্রাইডের বিশেষত্ব হল, এর দুই পাশের ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যই একেবারে ভিন্ন।
এর মধ্যে একটি পাশ গ্যালিয়াম বা ‘ক্যাশন সাইড’ নামে পরিচিত, যা এলইডি ও লেজারের মতো ফটোনিক ডিভাইসে ভালো কাজ করে। আর এর অন্যপাশ অর্থাৎ নাইট্রোজেন বা ‘অ্যানিয়ন সাইড’ বিভিন্ন ট্রাঞ্জিস্টর হোস্টিংয়ের বেলায় সহায়ক।
এখন পর্যন্ত কেউই এমন ডিভাইস বানাতে পারেননি, যা সেমিকন্ডাক্টরের উভয় পাশ একইসঙ্গে আলাদা আলাদা ফাংশনের জন্য ব্যবহার করতে পারে।
কর্নেল ইউনিভার্সিটির দুই অধ্যাপক দেবদিপ জেনা ও হুইলি গ্রেস শিংয়ের নেতৃত্বে গবেষণা দলটি এমন এক চিপ বানিয়েছে, যেটির এক পাশে ‘হাই ইলেকট্রন মোবিলিটি ট্রানজিস্টর (হেমট)’ ও অন্যপাশে ‘লাইট-এমিটিং ডায়োড (এলইডি)’ রয়েছে।
এর মতো কোনো সমাধান, এর আগে কোনো উপাদান দিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
প্রকল্পটি শুরু হয় কর্নেলে, যখন জেনা ও তার সাবেক পোস্ট ডক্টোরাল সহকারী গবেষক হেনরিক টুরস্কি একটি গ্যালিয়াম নাইট্রেডের ওয়েফারের উভয় পাশ ব্যবহার করার আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরু করেন।
মাইক্রোচিপের মূল অংশ, অর্থাৎ অসংখ্য সেমিকন্ডাক্টর যে পাতলা সারফেইসে বসানো হয়, তাকে চিপ প্রযুক্তির ভাষায় ডাকা হয় ওয়েফার।
এ গবেষণাপত্রের সহঃ জ্যেষ্ঠ লেখক টুরস্কি পোলিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস-এর ‘ইনস্টিটিউট অফ হাই ফিজিক্স’ বিভাগের একদল গবেষকের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেছেন, যেখানে তারা প্রায় চারশ মাইক্রন পুরু একক ক্রিস্টালের ওয়েফারের ওপর গ্যালিয়াম নাইট্রাইডের স্বচ্ছ বা ট্রান্সপারেন্ট স্তর বসানোর চেষ্টা করছিলেন।
পোল্যান্ডে বসে গবেষণা দলটি ‘হেমট’ ও ‘এলইডি’ তৈরি করে, যেখানে তারা ‘মলিকিউলার বিপ এপিট্যাক্সি’ নামের পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। চিপটি তৈরি হওয়ার পরপরই সেটা কর্নেলে পাঠানো হয়, যেখানে চিপের নাইট্রোজেনওয়ালা পাশে হেমট তৈরি ও প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে কাজ করেছেন কর্নেল ইউনিভার্সিটি’র শিক্ষার্থী ইউংকিউন কিম। এই পাশ নিয়ে কাজ করা কিছুটা চ্যালেঞ্জিং কারণ এটি রাসায়নিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল, যার ফলে এর প্রক্রিয়া চলার সময় চিপ ভেঙে যাওয়ার বড় ঝুঁকি থাকে।
এজন্য কিম খুবই সতর্কভাবে বিভিন্ন নতুন পদ্ধতি যাচাই করে দেখেন যাতে চিপের ট্রাঞ্জিস্টর ক্ষতির মুখে না পড়ে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়।
অন্যদিকে, ইউনিভার্সিটি’র আরেক শিক্ষার্থী লেন ভ্যান ডিউরজেন গ্যালিয়াম পাশের জন্য এলইডি তৈরি করেছেন। এ ছাড়া, নাইট্রোজেন পাশটি সুরক্ষিত রাখতে তিনি একটি পুরু প্রলেপও ব্যবহার করেছেন নিশ্চিত করা যায় যে, এর এলইডি তৈরির সময় সে অংশে কোনো প্রভাব না পড়ে।
প্রতিটি ধাপ শেষ হওয়ার পর ডিভাইসগুলো কাজ করছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখেছে গবেষণা দলটি। মজার বিষয় হল, তাদের সবাইকে চমকে দিয়ে ডিভাইসগুলো স্থিতিশীল অবস্থাতেই ছিল।
পরবর্তীতে, নতুন ডুয়াল-সাইডেড চিপ পরীক্ষা করতে গবেষকদেরকে নতুন একটি প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করতে হয়েছে। এতে তারা দু’পাশওয়ালা কাঁচের প্লেট ও চাকতির একপাশে তারের সংযোগ দেন, যার ফলে উভয় পাশ একইসঙ্গে পরীক্ষা করার সুযোগ মিলেছে।
দেবদিপ জেনা একে তুলনা করেছেন আইফোন উদ্ভাবনের সঙ্গে, যা তখন স্রেফ ফোন নয়, বরং একটি আইপড, ম্যাপ এবং ইন্টারনেটে প্রবেশের উপায় হিসেবেও বিবেচিত হয়েছিল। একইভাবে, এ ডুয়ালট্রনিক চিপ একটি ডিভাইসে একইসঙ্গে একাধিক ফাংশন ব্যবহারের সুযোগ দেয়, যা ভিন্ন ভিন্ন প্রসেসর ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আনার পাশাপাশি বিদ্যুৎ খরচও কমানোর সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।
এমনকি ৫জি ও ৬জি সংযোগের বেলাতেও এটি ব্যবহার করা যেতে পারে, যেখানে গ্যালিয়াম নাইট্রাইডে থাকা উচ্চমানের পাইজোইলেকট্রিক বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন সংকেত পরিশোধন করতে ও এর উন্নয়ন করা সম্ভব। পাশাপাশি, চিপটি লেজারের মধ্যে বসিয়ে আলোভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থাও তৈরির সম্ভাবনাও আছে, যা ‘লাইফাই’ নামেও পরিচিত।