তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের দাপ্তরিক কার্যালয় আগারগাঁও এর আইসিটি টাওয়ারে অবস্থিত। এই ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরেই রয়েছে আইসিটি বিভাগ ও এর আওতাধীন দপ্তর, সংস্থা ও প্রকল্পের কার্যালয়। আগষ্ট বিপ্লবের পর থেকেই অন্যান্য সরকারি অফিসের মতো এই ভবনেও বিভিন্নভাবে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হয়েছে। আনসার ক্যু এর দিন পর্যন্ত এই ভবনে বিভিন্ন দাবী-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনের নামে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে একটি চক্র। মূলত সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের সিন্ডিকেট ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সাবেক কর্মীরাই এই অরাজকতা সৃষ্টির নেপথ্যে কাজ করেছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে ও টেকজুমের নিজস্ব অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
আইসিটি অধিদপ্তরের সূ্ত্রে জানা গিয়েছে, পলকের দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময়ের রাজত্বকালে তিনি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের প্রচুর নেতাকর্মীকে বিভিন্ন পদে বসিয়েছেন। এছাড়া আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থায় শুধু নাটোর ও সিংড়ার ক্যাডারই আছ প্রায় শতাধিক। আগস্ট বিপ্লবের পরে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম। দায়িত্ব নিয়েই তিনি এই মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিলে ভীত হয়ে পড়ে ওই চক্রের সুবিধাভোগীরা। এরপর নতুন কৌশলে এগোতে থাকে তারা।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ১২ আগস্ট উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম প্রথমবারের মতো আইসিটি টাওয়ারে গেলে আওয়ামী লীগের সাথে ঘনিষ্ঠ কিছু কর্মকর্তা ও প্রকল্পের পরিচালকদের উস্কানিতে প্রধান ফটকের সামনে স্লোগান দেয় কিছু কর্মচারি। নিজেরা বৈষম্যের শিকার দাবী করে স্লোগান দিলেও এরা ছিলো মূলত রাজনৈতিক বিবেচনায় পলকের রাজত্বকালে নিয়োগ পাওয়া ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডার। এরপর প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন দাবী-দাওয়া নিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে চক্রটি। কখনো প্রধান ফটক আটকে রেখে, কখনো বা বিভিন্ন কর্মকর্তাকে নিজ কক্ষে আটকে রেখে তারা আইসিটি টাওয়ারে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। ধর্মঘট ও কর্মবিরতির নামে তারা সরকারি কাজে বিঘ্ন ঘটাতে মরিয়া হয়ে কাজ করছে বলে সূত্রটি জানিয়েছে। সর্বশেষ গত ১৫ আগস্ট নৈরাজ্যকারীরা একজন সাংবাদিককে বেদম প্রহার করে উত্তেজনায় নতুন মাত্রা যোগ করে। সূত্র বলছে, শুধু বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পেই আউটসোর্সিং ও কনসালটেন্ট এর নামে শতাধিক ক্যাডারকে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে যাদের একটি বড়ো অংশই পলকের নিজের নির্বাচনী এলাকা নাটোরের সিংড়ার বাসিন্দা।
আরো পড়ুন : পলকের অনুষ্ঠান সম্প্রচারের একচেটিয়া কাজ পাওয়া ঢাকা লাইভ ‘উধাও’
হাই-টেক পার্কের সাবেক এমডি বিকর্ণ কুমারের কাছে বিভিন্ন সময় হয়রানির শিকার একজন কর্মচারি জানান, আইসিটি বিভাগের আওতাধীন শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টার (১১টি) প্রকল্পে আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় নাটোরের সিংড়া উপজেলার কমপক্ষে ১০ জন কর্মচারি আছেন। এরমধ্যে সোহাগ মিলন, নিলয় কুমার, বাপিন সাহা, মনিরুল ইসলাম ও বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী চিহ্নিত ছাত্রলীগ ক্যাডার। এছাড়া ওই প্রকল্পে কর্মরত প্রিয়াংকা ঘোষ হাই-টেক পার্কের সাবেক এমডি বিকর্ণ কুমার ঘোষের সুপারিশে নিয়োগ প্রাপ্ত, তারা দুজনই যশোরের বাসিন্দা। প্রিয়াংকা ঘোষের বিরুদ্ধেও হাই-টেক পার্কের আরেক পিওন যশোরের বাসিন্দা রাহুল ঘোষের মাধ্যমে আউটসোর্সিং নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে তাদেরকে সার্বিক সহযোগিতা করে হাই-টেক পার্কের পরিচালক তবিবুর রহমান। গুঞ্জন রয়েছে তবিবুর রহমানের সাথে প্রিয়াংকা ঘোষের অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এখানে উল্লেখ্য হাই-টেক পার্কের সাবেক এমডি বিকর্ণ কুমার ঘোষ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। একারণে হাই-টেক পার্কে ও এর উন্নয়ন প্রকল্পে নিয়োগপ্রাপ্ত আউটসোর্সিং কর্মচারিদের বেশিরভাগই নাটোর ও যশোরের বাসিন্দা। এরা পলক ও বিকর্ণ কুমার ঘোষের অনুগত ও ছাত্রলীগ যুবলীগের বাছাই করা ক্যাডার।
আরো পড়ুন : পলকের চাপে ওরাকলকে সরাসরি ১৮ মিলিয়ন ডলারের টেন্ডার
ভারতের কাছে অসম ঋণের মাধ্যমে চলমান আরেকটি প্রকল্প জেলা পর্যায়ে আইটি/হাই-টেক পার্ক স্থাপন (১২টি জেলায়)। এই প্রকল্পে পলকের বডিগার্ড হিসেবে পরিচিত মিজানুর রহমান। প্রকল্প সূত্রে জানা গিয়েছে মিজান পলকের খুবই ঘনিষ্ঠজন। এমনকি তার পলকের সহকারি একান্ত সচিব হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে সে এখন এই প্রকল্পেই কাজ করছে। সে ওই প্রকল্পের বিভিন্ন কেনাকাটার সাথে জড়িত বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গিয়েছে। সাম্প্রতিক আইসিটি টাওয়ারে অরাজকতায় সে পেছন থেকে নেতৃত্ব প্রদান করেছে বলে আইসিটি অধিদপ্তরের আরেকটি সূত্র দাবি করেছে।
আরো পড়ুন : লিয়েন না পেয়ে বিসিএস চাকরি ছেড়ে আইসিটিতে পলকের বন্ধু
টেকজুমের এর দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে, আইসিটি বিভাগে পলকের দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময়ের রাজত্বকালে তিনি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের প্রচুর নেতাকর্মীকে বিভিন্ন পদে বসিয়েছেন। এছাড়া আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থায় শুধু নাটোর ও সিংড়ার ক্যাডারই আছ প্রায় শতাধিক। শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টার গুলোতে যুবলীগ-ছাত্রলীগের ক্যাডার সংখ্যা রয়েছে ১৮ জন আর নাটোর ও সিংড়ার থেকে রয়েছে ১২ জন । জেলা পর্যায়ে আইটি/হাই-টেক পার্কে যুবলীগ-ছাত্রলীগের ক্যাডার সংখ্যা রয়েছে ১১ জন এবং নাটোর ও সিংড়ার থেকে রয়েছে ৭ জন । শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টারে রয়েছে যুবলীগ-ছাত্রলীগের ৯জন এবং নাটোর ও সিংড়ার ৩ জন । বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি-২ এর সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে যুবলীগ-ছাত্রলীগের রয়েছে ৩ জন এবং নাটোর ও সিংড়ার ১ জন । ডিজিটাল উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবন ইকো-সিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্পে রয়েছে যুবলীগ-ছাত্রলীগের ২ জন । বাংলাদেশ-ভারত ডিজিটাল সেবা ও কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ (বিডিসেট) কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাকরণ শীর্ষক প্রকল্পে রয়েছে যুবলীগ-ছাত্রলীগের ৪ জন এবং নাটোর ও সিংড়ার ১ জন ।
আরো পড়ুন : কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বহাল তবিয়তে হাই-টেক পার্কে পলকের বান্ধবী তানজিলা
এদের নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে সবচেয় তৎপর ছিলো পলকের সাবেক সহকারি একান্ত সচিব বর্তমানে ডাটা সেন্টারে কর্মরত রঞ্জিত কুমার, পলকের দপ্তরের কম্পিউটার অপারেটর বর্তমানে হাই-টেক পার্কে সংযুক্ত কর্মচারি আনোয়ার হোসেন, পলকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ছাত্রলীগ ক্যাডার সাদ্দাম হোসেন ও রাকিবুল ইসলাম এবং আইসিটি বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধের কোটায় নিয়োগ পাওয়া রাশেদুর রহমান। রঞ্জিতের নেতৃত্বে এই চক্রটি নাটোরের সিংড়া থেকে যাদেরকে নিয়োগ দিয়েছে এদের কারো কারো থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়েছে। আবার কিছু কর্মচারিকে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে নিয়োগ দিয়ে তাদের মাধ্যমে টেন্ডারের প্রাক্কলনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইসিটি অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান প্রতিমন্ত্রী পলকের এলাকার লোক হওয়ায় এসব পিওন-ড্রাইভার-পরামর্শকদের ভয় পেতেন কর্মকর্তারা। এমনকি যে পদে তাদেরকে নিয়োগ দেয়া হতো সে পদের কোনো কাজ তারা করতো না। অনেকে দিনের পর দিন অফিসে না এসেও মাস শেষে বেতন তুলে নিয়েছেন। একদিনে পুরো মাসের হাজিরায় স্বাক্ষর করার নজিরও আছে প্রচুর। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের একজন কর্মকর্তা জানান প্রকল্প পরিচালকদের কেউ কেউ তাদেরকে শাসন করার চেষ্টা করে অফিসে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চাইলে উল্টো তাদের নামে প্রতিমন্ত্রীর কাছে বিচার দিত ছাত্রলীগের ক্যাডার এসব কর্মচারিরা। পরে প্রকল্প পরিচালকদের অনেকেই উল্টো এদের মাধ্যমে পলকের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন এবং বিভিন্ন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
আইসিটি অধিদপ্তর সূত্র বলছে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ প্রাপ্ত ছাত্রলীগ-যুবলীগের এসব ক্যাডার আইসিটি টাওয়ারে স্থাপিত ডাটা সেন্টারে যেকোনো সময় নাশকতা চালাতে পারে বলে আশংকা রয়েছে। এছাড়া এদের মাধ্যমে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথি গায়েব করার চেষ্টা চলছে বলে সূত্রটি জানিয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন দপ্তরে ক্যাডার ও নন ক্যাডার পর্যায়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সক্রিয় রাজনীতি করা কয়েক ডজন কর্মকর্তা আছে। এই কর্মকর্তাদের কেউ কেউ আড়ালে চলে গেলেও অনেকে আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় নিয়োগ প্রাপ্ত কর্মকর্তা-পিওন-ড্রাইভার ও পরামর্শক এবং কিছু রাজস্বভুক্ত তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারিকে উস্কে দিয়ে আইসিটি টাওয়ারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। এই অবস্থায় উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের জন্য আইসিটি টাওয়ার কতটা নিরাপদ তা নিয়ে আশংকা থেকেই যায়।