বাংলাদেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট শিল্প বিগত এক দশকে ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে। বর্তমানে দেশে ব্যবহৃত হ্যান্ডসেটের প্রায় ৯৯ শতাংশই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হলেও, চিত্রের অন্য প্রান্তে বিরাজ করছে এক গভীর সংকট—অবৈধভাবে আমদানি করা মোবাইল ফোন। বিটিআরসি তিন দফা উদ্যোগ নিয়েও এখনো পর্যন্ত এনইআইআর (ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার) পুরোপুরি চালু করতে পারেনি। ফলে রাজস্ব, নিরাপত্তা এবং বিনিয়োগ সবই পড়েছে চরম ঝুঁকিতে।
মোবাইল বাজারের প্রকৃতি ও অবৈধ হ্যান্ডসেটের দাপট
বর্তমানে দেশের মোবাইল হ্যান্ডসেট বাজারের আকার আনুমানিক ১৫ হাজার কোটি টাকা। এই বাজারে প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ দখল করে আছে অবৈধ বা চোরাই মোবাইল ফোন। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে সচল থাকা প্রায় ২০ লাখ আইফোনের মধ্যে মাত্র ২০০টি বৈধভাবে আমদানিকৃত। স্যামসাং-এর ক্ষেত্রেও একই চিত্র—২ কোটি ৩১ লাখ সচল হ্যান্ডসেটের মধ্যে ১ কোটি ৪৯ লাখ অবৈধ। এইসব অবৈধ হ্যান্ডসেট বিটিআরসির এনএআইডি ডেটাবেইজে নিবন্ধিত নয়।
এনইআইআর: পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও ব্যর্থতা
২০২১ সালে এনইআইআর বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। পরবর্তীতে ২০২৪ এবং সর্বশেষ ২০২৫ সালে আবারো এটি চালুর পরিকল্পনা নেয় বিটিআরসি। কিন্তু প্রতিবারই অজানা কারণে কিংবা ‘অদৃশ্য কলকাঠির’ প্রভাবে উদ্যোগটি থেমে যায়। টেন্ডার সংক্রান্ত জটিলতা, প্রশাসনিক বিলম্ব এবং রাজনৈতিক অনিচ্ছা এই ব্যর্থতার পেছনে মূল কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বিপুল রাজস্ব হারানোর হিসাব
সরকার শুধু আইফোন আমদানিতে বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে, যা দেশের মোবাইল খাতের বার্ষিক টার্নওভারের সমান। বৈধ ফোন আমদানিতে যেখানে ৫৮ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আছে, সেখানে অবৈধ ফোন বিনা করেই বাজারজাত হচ্ছে। ফলে সরকার বছরে কমপক্ষে দুই হাজার কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বিনিয়োগ ঝুঁকিতে, কর্মসংস্থান অনিশ্চিত
দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে মোবাইল ফোন উৎপাদন কারখানা স্থাপন করেছেন। সরাসরি ৩ থেকে ৪ লাখ মানুষ এই শিল্পে যুক্ত। কিন্তু অবৈধ ফোনের কারণে বাজার সংকুচিত হওয়ায় এইসব বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এমআইওবি (মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) এই সংকট নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ চেয়েছে।
নিরাপত্তা ঝুঁকিও কম নয়
সন্ত্রাস, হুন্ডি এবং সাইবার অপরাধে অবৈধ ফোন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কারণ এসব ফোন সিম রেজিস্ট্রেশনের বাইরে থাকে এবং আইএমইআই নম্বর এনইআইআরে নিবন্ধিত না হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে অপরাধী শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
বিটিআরসির অবস্থান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বিটিআরসি জানিয়েছে, তারা নতুন করে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় গিয়ে এনইআইআর চালুর চেষ্টা করছে। তবে এতে সময় লাগবে আরও ১-১.৫ বছর। এরমধ্যে সিস্টেম সচল রাখতে বিটিআরসিকে প্রতি মাসে ৩.৫৯ লাখ টাকা ব্যয় করতে হবে এবং ওয়ারেন্টি শেষ হওয়ায় নতুন করে এএমসি করতে হবে, যার বার্ষিক ব্যয় সাড়ে তিন কোটি টাকার বেশি।
সমাধান ও সুপারিশ
এনইআইআরের দ্রুত কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ টেন্ডার প্রক্রিয়া চালু করা
মোবাইল হ্যান্ডসেটের উপর কর হ্রাস করে বৈধ পণ্য সবার নাগালে আনা
বিটিআরসির প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি ও স্বতন্ত্র প্রযুক্তিবিদদের পরামর্শে কার্যক্রম পরিচালনা
রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে যেকোনো প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপ ঠেকানো
বাংলাদেশে মোবাইল প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং অর্থনীতিতে ডিজিটালাইজেশনের জন্য হ্যান্ডসেট একটি অপরিহার্য উপাদান। এই খাতে বিশৃঙ্খলা মানে ডিজিটাল ভবিষ্যতের পথ রুদ্ধ হওয়া। এখন সময় এসেছে অবৈধ ফোনের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের। এনইআইআরের বাস্তবায়ন বিলম্বিত না হয়ে যেন হয় প্রযুক্তিগত স্বচ্ছতা ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার প্রতীক—এটাই জনগণের প্রত্যাশা।