একটি অদৃশ্য কোম্পানি, যেখানে চেয়ারম্যান চিনেন না এমডিকে, আর এমডি জানেন না কে তার চেয়ারম্যান। অফিসের ঠিকানাও ভুয়া। অথচ এই মিথ্যা পরিচয়ের আড়ালে কোটি কোটি টাকা পাচার হয়েছে তৃতীয় দেশে—দেশের সবচেয়ে আলোচিত মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’-এর নামে।
গত আট বছরে লাখ লাখ গ্রাহকের আমানতের শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে ‘নগদ সিন্ডিকেট’। এই সিন্ডিকেটে যুক্ত ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা, মন্ত্রী-এমপিদের ঘনিষ্ঠজন এবং সরকারি কর্মকর্তারা। এমনকি সংশ্লিষ্টতা ছিল প্রধানমন্ত্রীর এক উপ প্রেস সচিবেরও। কারও কারও বিরুদ্ধে তদন্ত না হওয়ায় এখনও তারা বহাল তবিয়তে রয়েছেন, এমনকি নতুন প্রশাসনের সামনে নিজেদের ‘নগদ সংস্কারক’ বলেও তুলে ধরছেন।
মালিকানা রহস্য আর জাল কোম্পানির বিস্তার
২০১৯ সালে নিবন্ধিত ‘ফিনটেক হোল্ডিংস লিমিটেড’ নামের একটি কোম্পানিকে ব্যবহার করে শুরু হয় নগদের অর্থপাচার প্রক্রিয়া। ঢাকার বনানীর ডেল্টা ডালিয়া টাওয়ারে দেখানো ঠিকানায় প্রতিষ্ঠানটির কোনও অস্তিত্বই নেই। একই ঠিকানায় রয়েছে নগদের মূল কার্যালয় এবং ‘তাসিয়া হোল্ডিংস লিমিটেড’-এর একটি ছোট অফিস, যেখানে বড়জোর দু’জন কর্মী বসে থাকেন।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সেলিনা আক্তার নিজেই স্বীকার করেছেন তিনি প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা কী, তা জানেন না। এমডি এসএম কামালকে চেনেন না বলেও জানিয়েছেন। ডিরেক্টর সারোয়ার রহমান দিপু পর্যন্ত বলছেন, “আমি জানি না কোন কোম্পানির ডিরেক্টর আমি।” এরপরই ফোন কেটে দেন।
নগদের ৬% শেয়ারের মালিক ‘ব্লু ওয়াটার হোল্ডিংস লিমিটেড’-এর ঠিকানাও ভুয়া। চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন সাবেক এমপি নাহিম রাজ্জাক। আর ২.৪% শেয়ারের মালিক ‘তাসিয়া হোল্ডিংস লিমিটেড’ পরিচালিত হয় সাবেক পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ তানভির আহমেদ মিশুকের নেতৃত্বে।
তাসিয়া হোল্ডিংসের কার্যালয়ও নামমাত্র চলমান। ভবনের নিরাপত্তা কর্মীর ভাষ্য মতে, “আওয়ামী আমলে এখানে বড় বড় নেতারা আসতেন, এখন আর কেউ আসে না।”
২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার গরমিল
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রশাসক টিমের তদন্তে দেখা গেছে, ভুয়া এজেন্ট ও পরিবেশক দেখিয়ে ‘নগদ’-এ অতিরিক্ত ই-মানি তৈরি করে অন্তত ২,৩৫৬ কোটি টাকার হিসাব গায়েব করা হয়েছে। শেয়ার লেনদেনে ব্যাপক অনিয়ম, প্রভাবশালীদের নাম ব্যবহার করে কোম্পানি খোলার প্রবণতা, সব মিলিয়ে এটি একটি ‘ছদ্মবেশী আর্থিক সাম্রাজ্য’।
বিদেশি বিনিয়োগের মুখোশে টাকা পাচার
নগদ লিমিটেডের মোট ১৬৭ কোটি টাকার সাধারণ শেয়ারের মধ্যে ৭০.৯% বিদেশি পাঁচটি কোম্পানির হাতে। এরমধ্যে ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের ‘মিয়েরেশ হোল্ডিংস’-এর এককভাবে রয়েছে ৭০.৫%। বাকি চারটি কোম্পানির অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র ও হংকংয়ে, এবং শেয়ার পরিমাণ ১ শতাংশেরও কম। এই শেয়ারহোল্ডারদের পরিচয়ও স্পষ্ট নয়।
সন্দেহজনক লেনদেনে ৫০০ কোটি টাকা
২০২১-২২ অর্থবছরে ‘ক্যান্ডেলস্টোন ইনভেস্টমেন্টস পার্টনার লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি নগদে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। পরে এই বিনিয়োগ এক মাসের ব্যবধানে ‘সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড’-এর নামে শেয়ার রূপে হস্তান্তর করা হয়। এরপর মাত্র ছয় দিনে একটি ঋণচুক্তি ২৫ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসাইন খান বলেন, “নগদ নিয়ে সমস্যা অনেক আগে থেকেই ছিল। তবে ৫ আগস্টের পর সিন্ডিকেট পালিয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। তখনই আমরা প্রশাসক নিই। এখন অডিট চলছে—সবকিছু সামনে আসবে।”