দেশীয়ভাবে মোবাইল ফোন উৎপাদনে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ স্লোগানে যাত্রা শুরু করলেও কয়েক বছরের ব্যবধানে বন্ধ হয়ে গেছে একাধিক কারখানা। আবার অনেক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রেখে গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে কার্যক্রম। উদ্যোক্তারা বলছেন, আমদানি নির্ভরতা, কর বৈষম্য, বাজারে অবৈধ বা চোরাই ফোনের আধিপত্য, এবং সরকারি নীতির অনিশ্চয়তা—এই চারটি বড় কারণে ধুঁকছে পুরো মোবাইল ম্যানুফ্যাকচারিং খাত।
প্রতিশ্রুতি অনেক, বাস্তবায়ন শূন্য
২০১৭ সালের পর থেকে স্যামসাং, অপো, রিয়েলমি, সিম্ফনি, ওয়ালটন, ফাইভস্টারসহ অন্তত ১৪টি প্রতিষ্ঠান দেশেই ফোন তৈরির কারখানা চালু করে। কিন্তু ২০২4 সাল নাগাদ এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্তত ৫টি কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। কিছু কারখানায় চলছে কেবলমাত্র সীমিত পরিসরের অ্যাসেম্বলিং।
বাংলাদেশ মোবাইল ফোন আমদানিকারক সমিতির এক সদস্য বলেন, “সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দেশীয় উৎপাদনে কর সুবিধা, ব্যাংক ঋণ সহজীকরণ ও অবৈধ ফোন নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়ার। কিন্তু বাস্তবে কিছুই কার্যকর হয়নি।”
উৎপাদনের খরচ, আয় কম
দেশীয় মোবাইল কোম্পানিগুলোর একজন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “দেশে মোবাইল উৎপাদনের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয় প্রচুর ডলার খরচে। অথচ সেই ফোন যখন বাজারে আসে, তখন একই দামে অবৈধভাবে আসা চাইনিজ ফোন বা রিফারবিশড সেট আমাদের বাজার হারিয়ে দেয়।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা কর দিয়ে ফোন বানাই, অথচ আমদানি করা চোরাই ফোন কোনো শুল্ক ছাড়াই অনায়াসে বিক্রি হচ্ছে। এতে প্রতিযোগিতা অসম হয়ে পড়েছে।”
অবৈধ ফোনই কাল
বিটিআরসির তথ্যমতে, দেশে প্রতি মাসে ২–৩ লাখ অবৈধ ফোন প্রবেশ করে। এই ফোনগুলো কর ফাঁকি দিয়ে দেশে ঢুকে বৈধ ফোনের বাজার দখল করে নিচ্ছে।
সিম্ফনি, ওয়ালটনের মতো দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো এখন প্রায় ৫০% উৎপাদন কমিয়ে ফেলেছে। কিছু প্রতিষ্ঠান উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ করে আমদানিনির্ভর মডেলে ফিরে গেছে। স্যামসাং-এর স্থানীয় কারখানাতেও এখন সীমিত সংখ্যক মডেল তৈরি হচ্ছে।
অনেক উদ্যোক্তা অভিযোগ করেছেন, সরকার এখনো পূর্ণাঙ্গ ন্যাশনাল মোবাইল ম্যানুফ্যাকচারিং পলিসি ঘোষণা করেনি। ২০২১ সালে খসড়া তৈরি হলেও সেটি আর চূড়ান্ত হয়নি। ফলে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগে অনীহা দেখায়, রফতানির ক্ষেত্রেও নেই কোনো নীতিগত সহায়তা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় মোবাইল উৎপাদন হাব হতে পারত। এখানে দক্ষ শ্রমিক, বড় বাজার, এবং অবকাঠামো সুবিধা রয়েছে। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এই খাত থেকে প্রত্যাশিত কর্মসংস্থান বা বৈদেশিক আয় আসছে না।
ফোন উৎপাদনকারী এক প্রতিষ্ঠানের CEO বলেন “আমরা চাই কাজ করতে, দেশে ফোন বানাতে। কিন্তু চোরাই ফোন বন্ধ না হলে, এই শিল্প টিকবে না।”
টেলিকম বিশেষজ্ঞ রেজাউল করিম:
“যদি সরকার অবৈধ ফোন বাজার বন্ধ না করে, আর নীতিমালা ও অর্থনীতির কাঠামো অনুকূলে না আনে, তবে আগামী দুই বছরের মধ্যে মোবাইল উৎপাদন শিল্প পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।”
বাংলাদেশে মোবাইল ফোন উৎপাদন খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষ যুক্ত রয়েছেন।
প্রত্যক্ষভাবে জড়িতরা:
এই খাতে যেসব মানুষ সরাসরি কাজ করছেন:
-
কারখানার শ্রমিক ও টেকনিশিয়ান – প্রতি কারখানায় গড়ে ২০০–১০০০ জন (ওয়ালটন, সিম্ফনি, অপ্পো, স্যামসাং, ট্রানশান/টেকনো-আইটেল, রিয়েলমি, ফাইভস্টার ইত্যাদি মিলিয়ে অন্তত ১৫–২০টি কারখানা চালু রয়েছে)
-
ইঞ্জিনিয়ার ও কোয়ালিটি কন্ট্রোল টিম
-
প্যাকেজিং ও লজিস্টিকস কর্মী
-
সাপ্লাই চেইন ও ইনভেনটরি ব্যবস্থাপক
-
কাস্টমস ও ভ্যাট-সংক্রান্ত কর্মকর্তা (প্রাইভেট)
এই পরিসরে প্রায় ১০–১৫ হাজার মানুষ সরাসরি জড়িত।
পরোক্ষভাবে জড়িতরা:
এই খাতে যারা সংশ্লিষ্ট, কিন্তু কারখানায় কাজ করেন না:
-
বিক্রয় প্রতিনিধি ও রিটেইল সেলসম্যান
-
মার্কেটিং ও বিজ্ঞাপন সংস্থা
-
ডিস্ট্রিবিউশন ও ট্রান্সপোর্ট কর্মী
-
সার্ভিস সেন্টার ও রিপেয়ার টেকনিশিয়ান
-
খুচরা ও পাইকারি মোবাইল ব্যবসায়ী
-
প্যাকেজিং/বোর্ড/ব্যাটারি/চার্জার ইত্যাদি স্থানীয় যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী
এই পরিসরে আরও ৮–১০ হাজার মানুষ এই শিল্পে জড়িত।
সংক্ষিপ্ত চিত্র:
ক্যাটাগরি | মানুষ (প্রায়) |
---|---|
কারখানা ও উৎপাদন সংশ্লিষ্ট | ১০,০০০ – ১৫,০০০ জন |
বাজার, বিক্রয় ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনা | ৮,০০০ – ১০,০০০ জন |
মোট | ১৮,০০০ – ২৫,০০০ জন |