আন্তর্জাতিক ভয়েস কলের রাজস্ব আদায়ে দীর্ঘদিন ধরেই জটিলতা ও স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল। এবার সরাসরি মোবাইল অপারেটরদের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ এনেছে আইসিএক্স অপারেটররা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মোবাইল কোম্পানিগুলো পরিকল্পিতভাবে কল ট্রাফিকের প্রকৃত হিসাব গোপন করে সরকারকে বঞ্চিত করছে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক আয়ের অংশ থেকে।
কীভাবে হচ্ছে রেভিনিউ ফাঁকি?
আন্তর্জাতিক কল বাংলাদেশে ঢোকে আইজিডব্লিউ অপারেটরদের মাধ্যমে। এরপর তা আইসিএক্স (ইন্টার কানেকশন এক্সচেঞ্জ) হয়ে পৌঁছায় মোবাইল অপারেটরদের কাছে। কিন্তু আইসিএক্স অপারেটরদের দাবি, এই ট্র্যাফিক লাইনেই চলছে হিসাব জালিয়াতি। অভিযোগ অনুযায়ী, কলের প্রকৃত মিনিট রিপোর্ট করা হয় না, বরং সফটওয়্যার ম্যানিপুলেশন, রাউটিং বাইপাস এবং ‘সিম বেইসড গেটওয়ে’-এর মতো অবৈধ পদ্ধতি ব্যবহার করে মিনিট সংখ্যা কমিয়ে দেখানো হয়।
ফলে সরকার যেমন প্রতি মিনিটে নির্ধারিত ট্যাক্স ও ফি থেকে বঞ্চিত হয়, তেমনি আইসিএক্স অপারেটররাও তাদের ন্যায্য শেয়ার পান না। সবমিলিয়ে তৈরি হচ্ছে এক ধরনের ‘সিস্টেমেটিক চুরির চেইন’, যা টেলিযোগাযোগ খাতকে চরম অনিয়ম ও আস্থাহীনতায় ঠেলে দিচ্ছে।
আইসিএক্স মালিকদের বক্তব্য
বাংলাদেশ আইসিএক্স অ্যাসোসিয়েশনের একাধিক সদস্য জানান, “আমরা ২০টি কোম্পানি একসাথে এই সেক্টরে কাজ করি, কিন্তু ট্রাফিকের ৯০ শতাংশ চলে যায় ২-৩টি মোবাইল কোম্পানির ঘনিষ্ঠ আইসিএক্স অপারেটরে। এখানে রয়েছে একচেটিয়া রুট বরাদ্দ, ট্রাফিক শেয়ার না দেওয়া এবং আয় গোপনের অভিযোগ।”
তারা দাবি করেন, গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক – এই তিন মোবাইল অপারেটর নিয়মিতভাবে তাদের পছন্দের আইসিএক্স অপারেটরদের ট্রাফিক দিয়ে থাকে। বাকিদের ব্যবসা ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে, যাতে প্রতিযোগিতা না থাকে এবং দুর্নীতি গোপন রাখা সহজ হয়।
বিপিএলসি ও বিটিআরসির অবস্থান
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ও বাংলাদেশ পোস্ট অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস লিমিটেড (বিপিএলসি)-এর একাধিক কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল থেকে আন্তর্জাতিক ইনফ্লোতে পতন দেখা যাচ্ছে। তাদের মতে, “ভয়েস কল বাজারে হঠাৎ এতো দ্রুত পতনের যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই। এটা প্রযুক্তিগত বা বাজারগত নয়, বরং অভ্যন্তরীণ লুকোচুরির ফল।”
বিটিআরসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “আমরা বেশ কিছু সময় ধরে কল ডেটা রেকর্ড (CDR) বিশ্লেষণ করছি। এখানে ভয়েস ট্র্যাফিক ও বিলিংয়ে গড়মিল স্পষ্ট। কিন্তু প্রমাণ পাওয়ার পরেও শীর্ষ অপারেটরদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার মতো রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই।”
মোবাইল কোম্পানিগুলোর প্রতিক্রিয়া
এই প্রতিবেদনের অংশ হিসেবে মোবাইল অপারেটরদের পক্ষেও একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। তবে নির্দিষ্টভাবে কেউ লিখিত প্রতিক্রিয়া জানায়নি। বাংলালিংকের একজন মিডিয়া প্রতিনিধির দাবি, “আমরা টেলিকম নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করি, রেভিনিউ শেয়ারও যথাযথভাবে পরিশোধ করি।” তবে সেই রেভিনিউ ডেটার বিশদ ব্যাখ্যা ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন দিতে তারা রাজি হয়নি।
বিদেশে পাচার হচ্ছে কি?
অভিযোগ উঠেছে, আন্তর্জাতিক কল ট্রাফিকের অংশ বিশেষ ম্যানিপুলেট করে দেশীয় রেভিনিউ কম দেখানো হলেও, আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে পূর্ণ বিল নেওয়া হয়। ফলে এই ‘ডিফারেন্স অ্যামাউন্ট’ দেশে না এনে বিদেশে রেখে দেওয়া হয়। এতে করে অর্থপাচারের একটি সম্ভাব্য চক্রও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।