দেশে গ্রাহকসংখ্যায় শীর্ষ মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনকে আটকাতে নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।
নতুন বিধিনিষেধ অনুযায়ী, আগামী ১ জুলাই থেকে গ্রামীণফোন আগাম অনুমোদন ছাড়া কোনো ধরনের নতুন সেবা, অফার বা প্যাকেজ দিতে পারবে না। এখনকার অফার অথবা প্যাকেজও আবার অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে।
এ ছাড়া নম্বর ঠিক রেখে অপারেটর বদলে গ্রামীণফোনের ক্ষেত্রে ‘লকিং পিরিয়ড’ হবে ৬০ দিন। অন্যদের ক্ষেত্রে যা ৯০ দিন। এর মানে হলো, গ্রামীণফোন সহজে ছাড়া যাবে।
আজ রোববার বিটিআরসি এসব বিধিনিষেধের কথা জানিয়ে গ্রামীণফোনকে চিঠি দিয়েছে। বিটিআরসি চিঠিতে জানিয়েছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে গ্রামীণফোনের ক্ষেত্রে বাড়তি কলরেট (মিনিটে সর্বনিম্ন ৫০ পয়সা) আপাতত নির্ধারণ করে দেওয়া হলো না। এটা পরে বিবেচনা করা হবে।
অন্যদিকে গ্রামীণফোনের ক্ষেত্রে কল আদান-প্রদান বা টার্মিনেশন থেকে আয় কমিয়ে দেওয়ার (মিনিটে ১০ পয়সার বদলে ৫ পয়সা) বিধিনিষেধটি আরও যাচাই করে কমিশন পরে জারি করবে বলে উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।
বিটিআরসি গ্রামীণফোনের ওপর এসব বিধিনিষেধ আরোপ করেছে তাৎপর্যপূর্ণ বাজার ক্ষমতা প্রবিধানমালার (২০১৮) অধীনে। এর আওতায় সংস্থাটি গত বছর ১০ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণফোনকে তাৎপর্যপূর্ণ বাজার ক্ষমতাধারী (এসএমপি) অপারেটর হিসেবে ঘোষণা করে।
কোনো মোবাইল অপারেটর গ্রাহকসংখ্যা, রাজস্ব অথবা তরঙ্গ—এ তিন ক্ষেত্রের একটিতে ৪০ শতাংশের বেশি বাজার হিস্যাধারী হলে এসএমপি অপারেটর হিসেবে ঘোষণা করা যায়। গ্রামীণফোন গ্রাহকসংখ্যা ও অর্জিত বার্ষিক রাজস্বের দিক দিয়ে ৪০ শতাংশ বাজার হিস্যাধারী।
বিটিআরসি গ্রামীণফোনকে এসএমপি অপারেটর হিসেবে ঘোষণার পর গত বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি চারটি বিধিনিষেধ জারি করে। বিধিনিষেধগুলো ছিল মাসিক কলড্রপের সীমা ২ শতাংশের মধ্যে নিয়ে আসা, দেশজুড়ে কোনো প্রচার বা মার্কেট কমিউনিকেশন না করা , এমএনপির (নম্বর ঠিক রেখে অপারেটর বদল) ‘লক ইন পিরিয়ড’ ৩০ দিনে কমিয়ে আনা ও অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একক বা স্বতন্ত্র চুক্তি না করা। পরে আবার তুলে নেওয়া হয়। বিষয়টি আদালতেও গড়িয়েছিল।
করোনাকালে গ্রামীণফোন গত মে মাসে গ্রাহকদের বিনামূল্যে ১০ কোটি মিনিট দেয়। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কলরেট কমিয়ে দেয়। চিকিৎসকদের নামমাত্র মূল্যে ইন্টারনেট প্যাকেজ দেওয়ার ঘোষণা দেয়।
এরপরই বাকি তিন অপারেটর রবি আজিয়াটা, বাংলালিংক ও টেলিটক যৌথভাবে বিটিআরসিকে চিঠি দিয়ে এসএমপি অপারেটর হিসেবে গ্রামীণফোনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপের দাবি জানায়। রবির অভিযোগ ছিল, গ্রামীণফোন তাদের বাজারমুখী পদক্ষেপগুলোকে করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার মোড়কে উপস্থাপন করছে। গ্রামীণফোন বলেছিল, করোনাকালে সবারই মানুষকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসা উচিত।
এরপর বিটিআরসির এই পদক্ষেপ এল। এ বিষয়ে কমিশনের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য জানতে চাইলে সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক (গণমাধ্যম) মো. জাকির হোসেন খান বলেন, ‘টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কমিশন প্রতিনিয়ত বাজারের উপর নজর রাখছে। প্রতিটি অপারেটর যেন সমানভাবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে সে জন্য ইতিমধ্যে এসএমপি হিসেবে ঘোষণা করা অপারেটর গ্রামীণফোনের অনুকূলে গ্রাহক স্বার্থে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।’
জাকির খান বলেন, কমিশন আশা করে গ্রামীণফোন দেশের এ খাতের প্রচলিত আইন ও সংশ্লিষ্ট বিধি অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
বাজারের বড় অপারেটরের প্রতিযোগিতা বিরুদ্ধ আচরণ ঠেকিয়ে বাকি অপারেটরগুলোকে সুরক্ষা দিতে বিভিন্ন দেশে কোনো অপারেটরকে এসএমপি হিসেবে ঘোষণার নজির রয়েছে।
তবে গ্রামীণফোন বলছে, তাদের কোনো আচরণ প্রতিযোগিতা পরিবেশ বিনষ্ট করছে না। গ্রামীণফোনের পরিচালক ও হেড অব পাবলিক অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স হোসেন সাদাত এক লিখিত বিবৃতিতে প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের মোবাইল খাত যথেষ্ট প্রতিযোগিতামূলক। এখানে গ্রামীণফোন সময়োচিত বিনিয়োগ, নিত্যনতুন উদ্ভাবন ও ব্যবসায়িক পরিচালন দক্ষতার মাধ্যমে প্রসার লাভ করেছে। তিনি বলেন, সর্বশেষ বিধিনিষেধ এসএমপির মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে অসংগিতপূর্ণ। কেননা বাজার বিনষ্ট হয়েছে, এমন কোন প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে এটি আরোপ করা হয়নি।
হোসেন সাদাত আরও বলেন, ‘আরোপিত এই অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিধিগুলোই মূলত প্রতিযোগিতাবিরোধী, যা গ্রাহক স্বার্থের পরিপন্থী। এটা জাতীয় রাজস্ব, বিনিয়োগের পরিবেশের ওপর ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, গ্রামীণফোন চিঠিটি পর্যালোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করবে।