ভালো সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক। প্রথমদিকে সাড়াও ফেলেছিল ব্যাপক। সিমের এত চাহিদা ছিল যে প্রথমে লটারির মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছিল। কম কলরেটে বেসরকারি অপারেটরগুলোকে ফেলে দিয়েছিল হুমকিতে। সেই প্রতিষ্ঠানটিই এখন নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। গ্রাহক সংখ্যায় রয়েছে সবার নিচে। দেনার ভারে জর্জরিত। নেটওয়ার্কের অবস্থাও বেহাল। এ অবস্থায় সম্প্রতি টেলিটকের মাধ্যমে ফাইভ-জি সেবা দেওয়া থেকে সরে এসেছে সরকার। সবমিলিয়ে টেলিটকের অবস্থা এখন নিভু নিভু।
জানা যায়, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কাছে প্রতিষ্ঠানটির দেনা ১০০ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড বা বিটিসিএল ৮৩ কোটি টাকা পরিশোধের জন্য টেলিটককে চিঠি দিয়েছে।
এছাড়া বিটিসিএল, হুয়াওয়ে, সামিট, টাওয়ার কোম্পানি, ই-ডটকো এবং কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছেও দেনা রয়েছে টেলিটকের। বদলি করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককেও।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, এই ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নেই টেলিটকের। টিকে থাকতে হলে প্রতিষ্ঠানটিকে অন্য কোম্পানির সঙ্গে একীভূত (মার্জার) হতে হবে। এছাড়া টেলিটকের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) একেএম হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমি কয়েকদিন হলো দায়িত্ব নিয়েছি। এসব বিষয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছি। টেলিটকে অবশ্যই গ্রাহক আস্থা ফেরাতে কাজ করবো।’
টেলিটকের এ অবস্থার বিষয়ে জানতে সাবেক এমডি মো. সাহাবুদ্দিনকে ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। গত ৪ আগস্ট ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে তাকে বদলি করা হয়।
এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, আমরা যেটুকু বুঝি, অন্য অপারেটরদের চেয়ে টেলিটকের আর্থিক সক্ষমতা কম। সে কারণে হয়তো দেনা পরিশোধে তাদের বিলম্ব হয়েছে। টেলিটককে টাকা শোধ করার জন্য আমরা বলেছি। আশা করছি তারা তাড়াতাড়ি দেনা পরিশোধ করবে। এক্ষেত্রে আমাদের কোনো ছাড় নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠান বলে এটি কিন্তু নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়।
বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, টেলিটক বিকশিত না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো তাদের মার্কেটিং দুর্বলতা। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর সঠিক পরিকল্পনার অভাবেই টেলিটকের আজ এই অবস্থা। টেলিটককে টিকে থাকতে হলে এখন প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু সরকার এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী নয়। তাই টেলিটককে টিকে থাকতে হলে এখন এয়ারটেল-রবির মতো মার্জার করে ব্যবসা করতে হবে।
তিনি বলেন, টেলিটকের যে পরিমাণ দেনা আছে, সেই পরিমাণ সম্পদ নেই। সব বিক্রি করলেও দেনা পরিশোধ সম্ভব নয়।
এদিকে সরেজমিনে বাজার ঘুরে দেখা যায়, সহজে টেলিটকের সিম পাওয়া যায় না। রিচার্জ পয়েন্টও অনেক কম। নেটওয়ার্কের অবস্থাও ভালো নয়। এসব কারণে গ্রাহক টেলিটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
পাওনা পরিশোধে এরই মধ্যে টেলিটককে চিঠি দিয়েছে বিটিসিএল। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. রফিকুল মতিন বলেন, আমরা টেলিটকের কাছে ৮৩ কোটি টাকা পাবো। তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে টেলিটকের কাছে তরঙ্গ বাবদ পাওনা টাকার প্রথম কিস্তির ১০০ কোটি টাকা চেয়েছে বিটিআরসি। বিটিআরসির অর্থ হিসাব বিভাগ থেকে টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে গত ১ আগস্ট একটি চিঠি পাঠানো হয়।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেডের কাছে বিটিআরসির স্পেকট্রাম বিভাগ থেকে পাঠানো চিঠি মোতাবেক ২ হাজার ৬শ মেগাহার্জ ব্যান্ডের তরঙ্গ বরাদ্দ ফি-২০২২ এর প্রথম কিস্তির ১০ শতাংশ বাবদ অগ্রিম আয়কর ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর্তনপূর্বক ৯৩ লাখ ৩৯ হাজার ৭০১ টাকা এবং মূসক বাবদ ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হারে ৭৭ কোটি ৫ লাখ ৩ হাজার ৩০৮ টাকাসহ মোট ১০০ কোটি ৭৫ লাখ ৪৩ হাজার ৯ টাকা অনতিবিলম্বে ১৫ শতাংশ হারে প্রযোজ্য বিলম্ব ফিসহ পরিশোধ করার জন্য অনুরোধ করা হলো।’
বিটিআরসির এক কর্মকর্তা জানান, তরঙ্গ বরাদ্দের জন্য গ্রামীণফোন ও রবি প্রথম কিস্তি পরিশোধ করেছে। বাংলালিংক প্রথম কিস্তির জন্য ১৫ শতাংশসহ পরিশোধের শর্তে এক বছর সময় নিয়েছে। তবে টেলিটক (এখনো পরিশোধ করেনি। এজন্য টেলিটককে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, মোবাইল ফোনের সংযোগে শীর্ষে রয়েছে গ্রামীণফোন। তাদের সংযোগ সংখ্যা ৮ কোটি ৭৫ লাখ। রবির রয়েছে ৫ কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার সংযোগ, যা দ্বিতীয় স্থান। অন্যদিকে বাংলালিংক আছে তৃতীয় স্থানে। তাদের সংযোগ সংখ্যা ৩ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার। টেলিটকের সংযোগ সংখ্যা মাত্র ৫৬ লাখ ৫৭ হাজার।