তড়িঘড়ি করে আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে বিটিসিএল ৫জি প্রকল্পে কাজে হুয়াওয়েকে নিয়োগের প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দরপত্র উন্মুক্তকরণ নোটিশ দেওয়ার দিন থেকে থেকে শুরু করে হুয়াওয়ের কাজ পাওয়ার দিনটি পর্যন্ত সব ধরনের সরকারি কাজ নজিরবিহীন দ্রুতগতিতে এগিয়েছে। অভিয়োগ রয়েছে হুয়াওয়েকে কাজ দিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের (পিটিডি) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) সংক্রান্ত এক সভার কার্যবিবরণী থেকে অত্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের নির্দেশনা গায়েব করা হয়।
গত ডিসেম্বর মাসের বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভার কার্যবিবরণীতে এমনটা হয়েছে। সভার পরে প্রস্তুতকৃত খসড়া এবং প্রকাশিত চূড়ান্ত কার্যবিবরণী পর্যালোচনা করে সভার আলোচনা এবং প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশনায় ভিন্নতা দেখা যায়। এমনকি সভায় প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতি নিয়েও সচিবের আপত্তি থাকারও অভিযোগও উঠেছে।
বিভাগের একটি সূত্র পরিচয় গোপনের শর্তে জানান, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে যেখানে ‘দেখেশুনে’ এগোতে হচ্ছে, সেখানে মন্ত্রণালয়ের একটি পক্ষ তড়িঘড়ি করে অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার চেষ্টা করছেন। সংশ্লিষ্ট অধঃস্তন কর্মকর্তাদের কাছে আড়াল করতেই বিভাগের উচ্চ পর্যায় থেকে চূড়ান্ত কার্যবিবরণী বদলে ফেলা হয়ছিল।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এডিপি’র বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনায় বিগত ২৪ জানুয়ারি বিকেল ৩টায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সভাকক্ষে সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান এতে সভাপতিত্ব করেন। খসড়া কার্যবিবরণী অনুযায়ী, এই সভায় অন্তত ১৫টি প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়। এরমধ্যে ৫জি’র উপযোগীকরণে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রকল্প নিয়েও আলোচনা হয়। প্রকল্পের জিডি-০১ ডিডব্লিউডিএম ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক স্থাপন সম্পর্কে যুগ্মসচিব (পরিকল্পনা) ড. মো. তৈয়বুর রহমান সভাকে অবহিত করেন। প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) জানান জিডি-০১ প্যাকেজের চুক্তি গত বছরের ১৯ নভেম্বর একটি বেসরকারি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সাথে স্বাক্ষরিত হয় যার চুক্তিমূল্য ২৬ মিলিয়ন ৫৫৩ হাজার ৮৬৭ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৩১ কোটি ১০ লাখ ২০ হাজার ২৯ টাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) এর বিভিন্ন দরপত্রের নিয়ন্ত্রণ করত বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে সুবিধাভোগী ঠিকাদারদের একটি সিন্ডিকেট। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও সক্রিয় রয়েছে এই সিন্ডিকেট। বর্তমানেও তারা বিটিসিএলের কাজ পেতে মরিয়া। এই সিন্ডিকেটে রয়েছে নিঝুম এন্টারপ্রাইজ, হামিদা ট্রেডার্স, স্কাই লিমিট এন্টারপ্রাইজ, কে কে এন্টারপ্রাইজ ও রিলায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং। নিঝুম এন্টারপ্রাইজ ও হামিদা ট্রেডার্সের নেতৃত্বে সিন্ডিকেটে আছে দুই চীনা প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে ও জেডটিই।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে সরঞ্জাম সরবরাহকারী নিয়োগের দরপত্র বাতিল নিয়ে বিরোধে জড়িয়েছিলেন সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এবং একই মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান। সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার চেয়েছিলেন ‘সঠিক যন্ত্রপাতি’ সরবরাহকারী নিয়োগে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করতে। ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক চালু করতে ২০১৫ সালের পুরোনো মডেলের যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। ২০২৩ সালে এসে যেখানে আমরা সামনে অগ্রসর হব, সেখানে পুরোনো মডেলের যন্ত্রপাতি কেন কেনা হচ্ছে। আর সচিব চেয়েছিল আগে ডাকা দরপত্র অনুযায়ী কাজ দিতে। মন্ত্রী ও সচিবের বিরোধের মধ্যে বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরীকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এই পদে (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) ছিলেন।
সরঞ্জাম কেনার দরপত্রে প্রস্তাব দাখিল করে তিনটি কোম্পানি জেডটিই করপোরেশন, হুয়াওয়ে টেকনোলজিস লিমিটেড ও নকিয়া সলিউশন। তাদের সবাইকে যোগ্য হিসেবে মূল্যায়ন করে সাত সদস্যের কারিগরি কমিটি। অভিযোগ রয়েছে, তিন প্রতিষ্ঠানের কেউ দরপত্রের শর্ত পূরণ করতে পারেনি। তারপরও কারিগরি কমিটি তাদের যোগ্য ঘোষণা করে।
নথিপত্র বলছে, দরপত্র দলিলের শর্ত ভেঙে তিনটি কোম্পানিকে কেন কারিগরিভাবে যোগ্য বলা হলো, তা মূল্যায়ন কমিটির কাছে জানতে চান বিটিসিএলের তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরী। যে ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, তা সন্তোষজনক মনে হয়নি তাঁর কাছে। যেমন দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির ব্যাখ্যা ছিল, সনদে না থাকলেও নকিয়ার ওয়েবসাইটের তথ্যের ভিত্তিতে তাদের যোগ্য বলে গণ্য করা হয়েছে। অথচ দরপত্রে জমা দেওয়া নথির বাইরের তথ্যের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করার কোনো সুযোগ নেই।
ব্যাখ্যাতে আরও দেখা গেছে, হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে সনদ যাচাই করেছেন মূল্যায়ন কমিটির বাইরের এক কর্মকর্তা। অথচ আইনে দরপত্রের কোনো তথ্য মূল্যায়ন কমিটির বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। নথিপত্র বলছে, দরপত্রে ৪০০ গিগাবাইট লাইন ক্ষমতার যন্ত্রপাতি সরবরাহের অভিজ্ঞতার অন্তত একটি সনদ দেওয়ার কথা। সনদে ৪০০ গিগাবাইট উল্লেখ না থাকলে তা গ্রহণ করাই হবে না, এমন সতর্কতাও দেওয়া হয়। অথচ নকিয়ার সনদ ১০০ গিগাবাইট/২০০ গিগাবাইট ক্ষমতার যন্ত্রের। তবু মূল্যায়ন কমিটি তাদের কারিগরিভাবে যোগ্য ঘোষণা করে।
অনুসন্ধান বলছে, বিটিসিএলের পাশাপাশি বিএসসিসিএল এবং আইসিটি বিভাগের অধীনেও ফাইবার অপটিক্যাল কেবল সম্প্রসারণের কাজ করে এই সিন্ডিকেট। দরপত্রের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, এই সিন্ডিকেট বিটিসিএল, বিএসসিসিএল এবং আইসিটি বিভাগের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ‘খুশি’ রেখে কাজ করে।
নথিপত্র ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতির আয়ুষ্কাল ৭ থেকে ৮ বছর, যা দরপত্রেও বলা রয়েছে। অর্থাৎ যন্ত্রপাতির ব্যবহারযোগ্য কার্যকাল ২০৩০ সালে শেষ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) হিসাবে, এ সময়ে বাংলাদেশের ব্যান্ডউইডথ চাহিদা দাঁড়াবে ২৬ টেরাবাইট, যা প্রকল্পের প্রস্তাবে (ডিপিপি) অনুমোদিত। অথচ তার বদলে ৫ গুণ, অর্থাৎ ১২৬ টেরাবাইটের যন্ত্রপাতি দরপত্রে চাওয়া হয়েছে, যা অপচয়। আবার প্রয়োজনীয় সক্ষমতার যন্ত্রপাতি না কিনে পুরো টাকাই গচ্চা দিয়েছে।