আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনাদায়ী ফি আদায়ে জোয়ার এসেছে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) উদ্যোগে। আগষ্টের ১৮ তারিখে দেশের শীর্ষ টেলিকম প্রতিষ্ঠান সামিট কমিউনিকেশনস থেকে ১০ কোটি ২৪ লাখ টাকা আদায় করেছে শেয়ার ইক্যুইটি বৃদ্ধি ও শেয়ার মালিকানা পরিবর্তনের ফি।
অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ফাঁকি দেয়া এই অর্থ আদায়ের কথা নিশ্চিত করেছেন বিটিআরিসি’র ফাইন্যান্স বিভাগের কমিশনার মুশফিক মান্নান।
বিটিআরসি কমিশন সূত্রে প্রকাশ, সামিট কমিউনিকেশনস লিমিটেড এবং সাবমেরিন ক্যাবল সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস অপারেটর লােইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার ইক্যুইটি বৃদ্ধি এবং শেয়ার মালিকানা পরিবর্তনের কাজ শুরু হয়েছিলো চলতি বছরের ২৪ মার্চ থেকে। এই অনুমোদন পেতে বিটিআরসি-তে করা আবেদন ও সংশ্লিষ্ট নথিপত্রে বোঝা গিয়েছিলো নতুন শেয়ার ইস্যু করার আড়ালে আদতে সামিট শেয়ার হস্তান্তর ও বিক্রি করছিল। তাই শুরু থেকেই শেয়ার ইস্যুর চার্জগুলো সামিটের ওপরই আরোপ করতে চেয়েছিলো বিটিআরসি’র আইনি ও লাইসেন্সিং বিভাগ। কিন্তু সামিট কমিউনিকেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ফরিদ খান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও তৎকালীন বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খানের ছোট ভাই। ফরিদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়েরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় তখন এটি করতে ব্যর্থ হয়েছিলো কমিশন।
ফলশ্রুতিতে গত ১২ জুন কোনো ফি ছাড়াই সামিট কমিউনিকেশন শেয়ার হস্তান্তর করতে পারবে বলে সিদ্ধন্ত দিয়েছিলো বিটিআরসি‘র তৎকালীন প্রশাসন। তবে গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে আকস্মিকভাবেই সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সংস্থাটি। ওই সময় অফিসে অনুপস্থিত থাকেন ওই সময়ের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদ। চেয়াম্যানের অনুপস্থিতে অনুষ্ঠিত কমিশন বৈঠকে সামিট কমিউনিকেশনের নতুন শেয়ার ইস্যুর আড়ালে শেয়ার হস্তান্তর ও বিক্রির বিষয়টি জোরালো হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ আগষ্ট মিট কমিউনিকেশনকে তাদের শেয়ার হস্তান্তরের ফি না দেওয়ার সিদ্ধান্তটি পরিবর্তন হয়েছে জানিয়ে সংস্থার লাইসেন্সিং শাখা থেকে চিঠি পাঠায় বিটিআরসি। চিঠিতে হস্তান্তরিত চার্জের মোট বিক্রয় মূল্যের ওপর ৫.৫ শতাংশ হারে সমপরিমাণ অর্থ এবং এই অর্থের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রদান করতে ১০ দিনের সময় বেধে দেয়া হয়। তবে এবার কোনো ক্ষমতা বা আইনি পথে না হেঁটের পরের কর্ম দিবসেই চেক মারফত প্রাপ্য অর্থ বিটিআরসি হিসাবে জমা করে সামিট কমিউনিকেশন।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে আত্মপ্রকাশের পর বিগত ১৫ বছরে টেলিকম ও ইন্টারনেট সেক্টরের বৃহত্তম কম্পানিতে পরিণত হয় সামিট কমিউনিকেশন। প্রতিষ্ঠানটি মার্চের শেষের দিকে আবুধাবি ও মরিশাসভিত্তিক দুটি পৃথক কম্পানির কাছে ১৭০ কোটি ৫ লাখ টাকা মূল্যের নতুন শেয়ার ইস্যু করার জন্য বিটিআরসির অনুমোদন চায়। আবেদন অনুসারে, প্রতিটি ১২ টাকা দরে মোট ১৪ দশমিক ২০ কোটি নতুন শেয়ার ইস্যু করা হবে।
সেই সূত্রধরে এর এক মাস পর শেয়ার ইস্যুর প্রাক-অনুমোদনের জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠিয়ে পরের মাসেই অনুমোদন পেয়ে যায়। এরপর চলতি বছরের ১২ জুন সামিটকে কোনো চার্জ ছাড়াই শেয়ার ট্রান্সফারের অনুমতি দেয় বিটিআরসি।
সূত্রমতে, সরকারি অনুমোদনের জন্য পাঠানোর আগে বিটিআরসি আইন সংস্থার আইনি মতামত চেয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছিল- যেহেতু সামিট কেবল মাত্র নতুন শেয়ার ইস্যু করছে, তাই মোট শেয়ার বিক্রিয় মূল্যের ওপর ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ফি প্রদানের যে নিয়ম রয়েছে তা সামিট কমিউনিকেশনের জন্য প্রযোজ্য হবে না। এ ক্ষেত্রে সামিটও একই কথা উল্লেখ করে ‘এই ফি প্রযোজ্য নয়, কারণ কম্পানিটি নতুন শেয়ার ইস্যু করে তার মূলধন বাড়াচ্ছে।’
সামিটের পক্ষ থেকে বিটিআরসিতে জমা দেয়া শেয়ার বিক্রয় চুক্তি সংক্রান্ত নথি থেকে দেখা যায়, আবুধাবিভিত্তিক কোম্পানি গ্লোবাল এনার্জিকে সামিটের যে নতুন শেয়ার দেওয়ার কথা চুক্তি হয়েছে, তার শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে একজন হলেন আদিবা আজিজ খান, যিনি কমিউনিকেশন চেয়ারম্যান ফরিদ খানের বড় ভাই সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খানের মেয়ে। এ প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন শেয়ারের মধ্যে ১১৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকার ৯ দশমিক ৪৪ কোটি শেয়ার ইস্যু করা হয়েছিল। অন্যদিকে ৪৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা মূল্যের আরও ৪ দশমিক ৪ কোটি শেয়ার মরিশাসভিত্তিক সেকোইয়া ইনফ্রা টেককে দেওয়া হয়েছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ‘বাংলাদেশ ২.০’ রিফর্মেশন নাগরিক সমন্বয়ক ও বিডিজবস প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুর বলেন, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের হাতে আমাদের টেলিকম খাত নিরাপদ নয়। তাই এখনই আমাদের জাতীয় টেলিযোগাযোগ নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলা উচিত। একই ভাবে এসব কোম্পানির মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার করা টাকা দেশে ফেরত এনে কিভাবে স্থানীয় শিল্পে বিনিয়োগ করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা করা দরকার।