গ্রাহকদের মোবাইল ফোনে ব্যালেন্স শেষ হওয়ার সাথে সাথে গ্রাহক চাওয়া মাত্রই লোণ দিচ্ছে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো। এতে গ্রাহকরা খুশি হলেও গ্রাহকদের অজান্তেই প্রতি কলে যে পরিমান অতিরিক্ত অর্থ কেটে নেওয়া হচ্ছে, সেই তথ্যটা জানা নেই সিংহভাগ গ্রাহকেরই।
সম্প্রতি বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোনের তেজগাঁওয়ের কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে মধ্যবয়সী এক নারী আসেন একটি অভিযোগ নিয়ে। তার মোবাইল হিসাব থেকে অতিরিক্ত অর্থ কেটে নেওয়ার অভিযোগ নিয়ে আসেন। কাস্টমার কেয়ার অফিসের কর্মী তার ফোনটি পরীক্ষা করে বলেন, ‘আপনি লোন নিয়েছিলেন, তাই দুই টাকার বেশি মিনিট কেটেছে।’
শ্রমজীবী ওই নারী মুহূর্তেই ক্ষেপে উঠলেন। তিনি তার দুই হাত দেখিয়ে বলেন, ‘এই যে দেখেন, আমার চামড়া উইঠ্যা গেছে পরিশ্রমের কারণে। এই কষ্টের পয়সা আপনারা নিয়া নিবেন, আমি আর ফোনই ব্যবহার করুম না।’
ওই নারীর একটি প্যাকেজ নেওয়া ছিল যাতে মিনিটে ৫০ পয়সা করে কাটত। টাকা শেষ হয়ে যাওয়ার পর তাকে অগ্রিম ব্যালান্স দেয় গ্রামীণফোন। কিন্তু কোথাও বলা ছিল না যে, অগ্রিম হিসেবে দেওয়া ব্যালান্সে চার গুণ বেশি টাকা কাটবে।
এই কাজটি প্রতিটি মোবাইল ফোন অপারেটরই করছে। বাংলালিংক ও রবি তার প্রিপেইড গ্রাহকদের ব্যালান্স শেষ হয়ে গেলে সর্বনি¤œ ৫টাকা থেকে শুরু ২০০ টাকা পর্যন্ত আগাম ব্যালান্স হিসেবে দিয়ে থাকে যা লোন হিসেবেই পরিচিত। পরে টাকা রিচার্জ করলে ওই লোন কেটে নেওয়া হয়। আর আগাম হিসেবে দেওয়া ব্যালান্সের ক্ষেত্রে যে বেশি হারে টাকা কেটে নেওয়া হয়।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী মোবাইল ফোন অপারেটর প্রতি মিনিটে সর্বনি¤œ ৪৫ পয়সা এবং সর্বোচ্চ দুই টাকা কাটতে পারবে। তবে প্রিপেইড হিসাবে বেশিরভাগ প্যাকেজই ৪৫ পয়সা মিনিটের আশপাশে থাকে আর স্বল্প আয়ের মানুষ এসব প্যাকেজই ব্যবহার করে। এর মধ্যে টকটাইম শেষ হয়ে গেলে ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স বা লোন হিসেবে টাকা দিয়ে থাকে অপারেটর। আর কেবল এই অগ্রিম ব্যালেন্স চলাকালেই নয়, নতুন টাকা রিচার্জের পরও অতিরিক্ত হারে বিল নিয়ে থাকে অপারেটরগুলো।
তবে জনগণের পকেট কাটলেও সরকার এই বিষয়টি জানেই না। অতিরিক্ত টাকা কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘এই বিষয়ে আমি কিছু জানি না। এই ধরনের কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে এখনো আসেনি। আসলে অবশ্যই পদক্ষেপ নেব।’
মোবাইল ফোন কোম্পানির ঘোষণা অনুযায়ী, একজন গ্রাহক ঋণ নিলে তিনি রিচার্জ করা মাত্র সেই টাকা আগে কেটে নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দুই টাকা চার্জ এবং ভ্যাট যোগ করা হবে। তবে কলরেটে পরিবর্তনের কোনো কথাই জানানো হয়নি। অর্থাৎ গ্রাহক তার ব্যবহƒত কলরেটেই থাকার কথা। কিন্তু সেটি আর হচ্ছে না।
ঋণ নেওয়ার পর প্রায়ই এমন বিড়ম্বনায় পড়া গ্রামীণফোন ব্যবহারকারী জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, তিনি ১ পয়সা সেকেন্ড কলরেট ব্যবহার করেন। যেখানে নিয়ম অনুযায়ী এক মিনিটে তার ভ্যাটসহ ৭৫ পয়সা কলরেট কাটা হয়। কিন্তু তিনি ঋণ নেওয়ার পরই তার কলরেট পরিবর্তন হয়ে প্রায় ১ টাকা ৫০ পয়সার বেশি কেটে নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে গ্রাহকসেবা কেন্দ্রে গিয়েও কোনো সমাধান মেলেনি তার। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ব্যালেন্স শেষ হলেও আর ঋণ নেবেন না।
গ্রামীণফোন তাদের গ্রাহকদের ১০ টাকা থেকে শুরু ২০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিয়ে থাকে। গ্রাহকদের ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স নির্ধারণ করে প্রতিষ্ঠানটি।
অপারেটরটির ফার্মগেটের গ্রাহকসেবা কেন্দ্রের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা নরমালি হওয়ার কথা না। কারণ আমাদের এমন কোনো অপশন নাই, ঋণ নিলে কলরেট পরিবর্তন করা হয় না। তবে আমরা যেহেতু গ্রাককদের সেবায় সব সময় নিয়োজিত তাদের বলব, এ রকম হলে আপনারা অবশ্যই বাড়তি যে টাকা কাটছে সেটা স্ক্রিনশট রেখে দেবেন। আমরা বিষয়টা দেখব।’
বেসরকারি আরেক মোবাইল কোম্পানি রবি-এয়ারটেল তাদের গ্রাহকদের জন্য ১০ টাকা থেকে শুরু ১০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিচ্ছে। তারাও এই ঋণের ক্ষেত্রে কলরেট পরিবর্তন করে গ্রাহকদের পকেট কাটছে।
রবির গতি ৩৬ প্রিপেইড প্যাকেজ ব্যবহারকারী সুমাইয়া তাহমিন জানান, তিনি ঋণ নিলে রবি বাদ দিয়ে অন্য অপারেটরে কথা বললে ৫ থেকে ৭ পয়সার মতো বেশি কাটা হয়।
বলেন, ‘আমি শুরু থেকেই রবি গ্রাহক। অনেক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও আমি অন্য অপারেটরে যাইনি। আমি বিপদে পড়লে ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স নেই। ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স নিতে দেরি শেষ হতে দেরি লাগে না। খেয়াল করে দেখলাম এরা ঋণ নিলে কলরেট বেশি কাটে।’
এয়ারটেলে ৯০ পয়সা মিনিটের কলরেট ব্যবহারকারী এক গ্রাহক জানান, কলরেট আর ভ্যাট মিলিয়ে সব সময় ১ টাকা ৫ পয়সা কাটা হলেও ঋণের বেলায় বাড়তি টাকা কাটা হয়েছে। এতদিন তিনি বিষয়টি খেয়াল করেননি।
গ্রাহক পরিচয় দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ধানমন্ডি গ্রাহকসেবা কেন্দ্রে গিয়ে ঋণ নিলে অতিরিক্ত কলরেট কাটার বিষয়টি জানালে তাদের ভাষ্য, টেলিটক কোম্পানিটি কলরেট পরিবর্তন করেন না, আর বেশি টাকা কাটেও না। এ রকম হলে গ্রাহককে স্ক্রিনশট নিয়ে প্রমাণ দিলেই তারা ব্যবস্থা নিবেন বলে সাফ জানিয়ে দেন।
বাংলালিংক ব্যবহারকারী গ্রাহক জামিল বলেন, ‘এই সিমে সব অপারেটরে ১০ সেকেন্ডে ২২ পয়সায় কথা বলি। কিন্তু সমস্যা হয় যখন ঋণ নিই, দেখা যায় টাকা নেওয়া পর খুব তাড়াতাড়িই টাকা শেষ হয়ে যায়। কিছুদিন লক্ষ্য করে দেখলাম, লোন নেওয়া টাকা থেকে কয়েক পয়সা বাড়তি কাটা হচ্ছে।’