দেশের বহুজাতিক মোবাইল ফোন অপারেটর রবি আজিয়াটার বিরুদ্ধে বিধিবহির্ভূতভাবে প্রায় এক হাজার ৬৫৮ কোটি ৫১ লাখ টাকার মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট রেয়াত নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
তথ্য মতে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ে এ রেয়াত নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে প্রতিষ্ঠানটির ১১৬ কোটি টাকার অবৈধ রেয়াত উদঘাটন করা হয়। পরে পুন:নিরীক্ষার আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি। পুন:নিরীক্ষায় বিশাল অঙ্কের অবৈধ রেয়াত নেওয়ার সন্ধান পায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
বিষয়টিকে অনেকটা কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মতো বলে উল্লেখ করেছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা। রবির মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বিধি না মেনে বিপুল রেয়াত নেওয়ায় হতবাক তদন্ত কর্মকর্তারা। সম্প্রতি মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এ বিষয়ে এনবিআরে প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ-ভ্যাট) শাখাকে চিঠি দিয়েছে এনবিআর। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, এনবিআরের ভ্যাট এলটিইউ রবির ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাব নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেয়। নিরীক্ষায় যে বিষয়টি উঠে এসেছে তাতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির এসএপি সফটওয়্যার উদঘাটন করে ৫৫৩ কোটি ৬১ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি পাওয়া যায়। এছাড়া পরিহার করা অন্যান্য রাজস্বের মধ্যে রয়েছে উৎসে ভ্যাট ১৫৮ কোটি ২১ লাখ টাকা, মার্জার ফি ৯১ কোটি পাঁচ লাখ টাকা, ইন্টারকানেকশন চার্জ পাঁচ কোটি ২২ লাখ টাকা ও বিধিবর্হিভূতভাবে রেয়াত গ্রহণ ১১৬ কোটি ৪০ লাখ ৫১ হাজার টাকা।
এ নিয়ে রবির কাছে পৃথকভাবে চারটি দাবিনামা জারি করা হয়। পরে প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ আদালতে রিট করে। পরে আদালত এনবিআরের সঙ্গে বিষয়টি নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। এরপর রবি ফের এনবিআরের শরাণাপন্ন হয় এবং পুন:নিরীক্ষার আবেদন করে। এনবিআর মূসক নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরকে পুন:নিরীক্ষার নির্দেশ দেয়। ভ্যাট-এলটিইউ, সিআইসি, বন্ড কমিশনারেট, রবি ও বিটিআরসির কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে তদন্ত দল গঠন করে মূসক গোয়েন্দা। দীর্ঘ তদন্ত শেষে সম্প্রতি এনবিআরে প্রতিবেদন দেয় কমিটি। এতে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কিছুটা কমলেও বিপুল পরিমাণ অবৈধ রেয়াত নেওয়ার বিষয়টি উঠে আসে। তদন্ত দলের প্রতিবেদন অনুযায়ী রবির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি এনবিআর থেকে এলটিইউকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, তদন্ত দল প্রতিষ্ঠানটির দাখিলপত্র, ট্রেজারি চালান, মূসক-১১ চালান, হিসাব বিবরণী, বার্ষিক অডিট রিপোর্ট ও এসএপি সফটওয়্যার নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করে। এতে দেখা যায়, ব্যাটারি, কেব্ল, প্রিন্টেড বোর্ড, রাউটার সুইচ ইত্যাদি আমদানি করে রবি আজিয়াটা, কিন্তু ক্রয় হিসাব পুস্তকে তা যোগ করে না, যা মূসক আইনের লঙ্ঘন। এলটিইউ’র নিরীক্ষায় ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১৬ কোটি ৪০ লাখ ৫১ হাজার ৬২ টাকা অবৈধ রেয়াত নেওয়ার বিষয়টি উঠে আসে।
এলটিইউ’র প্রতিবেদনের সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য তদন্ত দল রবির ক্রয় হিসাব পুস্তক (মূসক-১৬) পরীক্ষা করে। এতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ক্রয় হিসাবে পণ্যের পরিমাণ উল্লেখ করেনি, যা আইনের লঙ্ঘন। এলটিইউ আমদানি পণ্য ছাড়া অন্য কোনো পণ্য বা সেবা ক্রয়ের বিপরীতে রেয়াত গ্রহণের বিষয়টি যাচাই করেনি। কিন্তু তদন্ত দল ক্রয় হিসাবে অন্তর্ভুক্ত নয় এমন পণ্য বা সেবার বিপরীতে বিধিবহির্ভূতভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ রেয়াত নেওয়ার বিষয়টি খুঁজে পেয়েছে। দাখিলপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিজ্ঞাপন খাত, প্রাপ্যতার অতিরিক্ত, সার্ভিস খাত, রেভিনিউ ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার শেয়ারিং সার্ভিস খাত, টাকা ও স্ক্র্যাচ কার্ডের ক্ষেত্রে, ব্র্যান্ড উইড্থ এন্টেনা চার্জের বিপরীতে, ইন্টার অপারেটর চার্জ খাত, জোগানদার খাত, সিকিউরিটি সার্ভিস খাত, ইউনিলিভার থেকে কসমেটিকস ক্রয়, সিঅ্যান্ডএফ কমিশন, বিদ্যুৎ বিল, ট্রান্সপোর্ট কন্ট্রাক্টর, অডিট ফি, স্ক্র্যাচকার্ড ও আদার প্রিন্টিং, কল ক্যারিং চার্জ ও টেলিকম ফেসিলিটি শেয়ারিং, বিমা খাতসহ কয়েকটি খাতের বিপরীতে বিধিবহির্ভূতভাবে রেয়াত নিয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৫৪ কোটি ৫২ লাখ ৭৫ হাজার ২৯ টাকার অবৈধ রেয়াত গ্রহণ করেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রবি ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি পণ্যের বিপরীতে চলতি হিসাব ও দাখিলপত্রের মাধ্যমে ৬৯২ কোটি ৬১ লাখ ২৩ হাজার ৪৯৭ টাকার অবৈধ রেয়াত নিয়েছে। একই সঙ্গে স্থানীয় ক্রয় বা সেবা গ্রহণের বিপরীতে ৯৬৫ কোটি ৮৯ লাখ ৭৯ হাজার ৭৮৪ টাকার অবৈধ রেয়াত নিয়েছে। দুটি খাতে মোট এক হাজার ৬৫৮ কোটি ৫১ লাখ তিন হাজার ২৮১ টাকা অবৈধ রেয়াত নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আরও দেখা যায়, ২০১৩ সালে প্রায় ২৮২ কোটি ৯০ লাখ, ২০১৪ সালে প্রায় ২৬৪ কোটি আট লাখ, ২০১৫ সালে প্রায় ৪৬৬ কোটি ৪৯ লাখ ও ২০১৬ সালে প্রায় ৬৪৫ কোটি দুই লাখ টাকা অবৈধ রেয়াত নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
অথচ প্রতিষ্ঠানটির ক্রয় হিসাব পুস্তকে আমদানি পণ্য ও স্থানীয় পর্যায়ে ক্রয় করা পণ্য বা সেবার তথ্য এন্ট্রি করা হয়নি। এলটিইউ’র প্রতিবেদনে আমদানি করা সুইচ, কেব্ল, ব্যাটারি, সিস্টেম ও প্রিন্টেড বোর্ডের বিপরীতে বিধিবহির্ভূত রেয়াত ১১৬ কোটি ৪০ লাখ ৫১ হাজার ৬২ টাকা বাতিলের সুপারিশ করা হয়। এর বাইরে তদন্ত দল রবির দাখিলপত্র পর্যালোচনা করে আমদানি করা পণ্যের মধ্যে ফার্নিচার, মোবাইল ফোন, অফিস ইকুইপমেন্ট ও রঙিন টেলিভিশনের বিপরীতে বিধিবহির্ভূতভাবে ৯ কোটি ৯০ লাখ ৭০ হাজার ৭০৬ টাকা উদ্ঘাটন করেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তদন্ত দলের উদ্ঘাটন করা অবৈধ রেয়াত এক হাজার ৬৫৮ কোটি ৫১ লাখ তিন হাজার ২৮১ টাকা। আর এলটিইউ’র উদ্ঘাটন করা অবৈধ রেয়াত ১১৬ কোটি ৪০ লাখ ৫১ হাজার ৬২ টাকা। এলটিইউ’র উদ্ঘাটন করা রেয়াত বাদ দিলে এক হাজার ৫৪২ কোটি ১০ লাখ ৫২ হাজার ২১৯ টাকা রবি অবৈধভাবে গ্রহণ করেছে। মূসক আইনের ধারা ৬ অনুযায়ী, বিধিবহির্ভূতভাবে গ্রহণ করা রেয়াত যথাসময়ে সরকারি কোষাগারে জমা না দেওয়ায় দুই শতাংশ হারে সুদ ৩০ কোটি ৮৪ লাখ ২১ হাজার টাকা। রেয়াতের সঙ্গে সুদ আদায়ের জন্যও তদন্ত দল সুপারিশ করেছে।
তদন্তকারী দলের একজন কর্মকর্তা বলেন, বহুজাতিক এমন একটি প্রতিষ্ঠান নন-কমপ্লায়ান্ট হবে, ভাবাই যায় না। বিপুল পরিমাণ অবৈধ রেয়াত ছাড়া অন্য রাজস্ব পরিশোধের ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানটির গলদ রয়েছে। আমরা ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছি।