অ্যালফাবেট ইনকরপোরেশনের ব্যবস্থাপনা থেকে ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিনের সরে দাঁড়ানোর ঘোষণায় খুশি নয় গুগলের সাবেক ও বর্তমান কর্মীরা। বৈশ্বিক সার্চ জায়ান্টটি কয়েক বছর ধরে নানা ইস্যুতে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিকভাবে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছে। কর্মী বাহিনীতে বৈচিত্র্যহীনতা এবং মানবাধিকার ও নীতি-নৈতিকতা বর্জন করে একের পর এক প্রকল্প হাতে নেয়ায় বেশি সমালোচিত হয় প্রতিষ্ঠানটি। যখন অ্যালফাবেট নিয়ন্ত্রিত গুগলের বিরুদ্ধে এত ভুল পদক্ষেপ নেয়ার অভিযোগ, তখন প্যারেন্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা থেকে দুই সহপ্রতিষ্ঠাতার সরে দাঁড়ানোর বিষয়টিকে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল মনে করছেন অনেক কর্মী। খবর বিজনেস ইনসাইডার।
গত মঙ্গলবার এক ব্লগ পোস্টে আকস্মিক গুগলের প্যারেন্ট কোম্পানি অ্যালফাবেট ইনকরপোরেশনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন গুগলের দুই সহপ্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এবং প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন। অ্যালফাবেটের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থেকে ৪৬ বছর বয়সী এ দুই প্রযুক্তি মহারথীর সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তে গুগলের অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতিতে আরো অবনতি ঘটবে বলে মনে করা হচ্ছে।
গুগলের সাবেক ও বর্তমান শীর্ষস্থানীয় অনেক কর্মীই ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিনের অ্যালফাবেটের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণার পর হতাশা প্রকাশ করে টুইট করেন। অনেকে আশা ব্যক্ত করেন, ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন তাদের সিদ্ধান্ত বদলাবেন; গুগলের অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতিতে যে ত্রুটি তা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন।
অতীতের চেয়ে এখন বেশি সমালোচিত হচ্ছে গুগল। এর প্রধান কারণ নীতিভ্রষ্ট প্রতিভাকে প্রতিষ্ঠানটির স্বীকৃতি দান। তবে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় এ ধরনের প্রতিভাকে এড়িয়ে চলারও উপায় নেই। পণ্যের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে অনেক নীতিভ্রষ্ট কর্মীকে ধরে রাখতে হয়। এতে আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠান লাভবান হলেও সুনাম নষ্ট হয়, যা প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডমূল্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এ বিষয়ে গুগল নিয়ন্ত্রিত ইউটিউবের জ্যেষ্ঠ পণ্য ব্যবস্থাপক টম কার্লো বলেন, কর্মীদের অনেকেই এখনো মনে করেন ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন তাদের নিজ নিজ দায়িত্বে ফিরবেন এবং গুগলের অভ্যন্তরীণ যে ত্রুটি, সেগুলো সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন।
জানুয়ারিতে গুগল থেকে অব্যাহতি নেয়া সফটওয়্যার প্রকৌশলী কলিন ম্যাকমিলান বলেন, গুগল প্রতিষ্ঠাতাদ্বয়ের সিদ্ধান্তকে আমার কাছে শুধু ফরমালিটি মনে হচ্ছে, যা আগে থেকেই অনেকে জানতেন। অর্থাৎ ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন গুগলের সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী নন।
গত মাসে গুগল থেকে ছাঁটাই হওয়া রেবেকা রিভার নামে এক নারী কর্মী জানিয়েছেন, কর্মীদের দাবি-দাওয়ার পক্ষে না দাঁড়িয়ে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা আসলে গর্বিত ও সাহসী।
গুগল নির্বাহীদের দ্বারা অধীনস্থ নারী কর্মীদের যৌন হয়রানির বিষয়টি নিয়েও তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার আন্দোলনে নেমেছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা। একযোগে বিশ্বব্যাপী গুগল কর্মীরা বিক্ষোভও করেন। গুগলের নীতিভ্রষ্ট প্রতিভা হিসেবে সবার আগে সাবেক অ্যান্ড্রয়েড বিভাগের প্রধান অ্যান্ডি রুবিনের নাম উঠে আসে। অধীনস্থ এক নারী কর্মীর সঙ্গে যৌন অসদাচরণের অভিযোগ থাকার পরও ২০১৪ সালের অক্টোবরে বীরের বেশে প্রতিষ্ঠান ছেড়েছিলেন তিনি। এমনকি আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকার পরও ওই সময় তাকে ৯ কোটি ডলার দেয়ার চুক্তি করেছিল গুগল।
অসদাচরণের অভিযোগ ওঠার পরও গুগল যে তিন নির্বাহীকে রক্ষা করেছিল, রুবিন তাদের অন্যতম। এ ধরনের দুটি ঘটনায় গুগল জ্যেষ্ঠ নির্বাহীদের প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দিয়েছিল। তবে আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকার পরও গুগল ছাড়ার বিনিময়ে তাদের বিপুল অর্থ পরিশোধের উদ্যোগ নেয়া হয়। তৃতীয় একটি ঘটনায় অভিযুক্ত নির্বাহীকে প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে বহাল রাখা হয়। এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবার অভিযোগ ওঠার পর গুগল নীরব ছিল।
গুগল চাইলে রুবিনকে বরখাস্ত ও খালি হাতে বের করে দিতে পারত। এর বদলে প্রতিষ্ঠানটি তাকে ৯ কোটি ডলার পরিশোধের উদ্যোগ নেয়। এ ব্যাপারে জ্ঞাত দুই ব্যক্তির ভাষ্য, চার বছরে প্রতি মাসে প্রায় ২০ লাখ ডলার কিস্তিতে রুবিনকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অর্থ পরিশোধ করা হয়। গত বছরের নভেম্বরে এ-সংক্রান্ত সর্বশেষ কিস্তি পরিশোধ করা হয়।
২০১৮ সালের জুনে পেন্টাগনের সঙ্গে ম্যাভেন প্রকল্পে কাজ না করার ঘোষণা দেয় গুগল। অথচ এ প্রকল্পে কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ ছিল প্রতিষ্ঠানটি। গুগলের একসময়ের স্লোগান ছিল ‘ডোন্ট বি ইভিল’। এর অনেক কর্মীই এ মন্ত্র মনে ধারণ করেন। প্রাণঘাতী উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে পারে, এমন প্রযুক্তি বা সেবা উদ্ভাবনের পক্ষে নন অনেকেই। যে কারণে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দপ্তর পেন্টাগনের এমনই একটি প্রকল্প ম্যাভেন নিয়ে নাখোশ ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির একদল কর্মী। তাদের আশঙ্কা, পেন্টাগন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে যে প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে, তা প্রাণঘাতী হতে পারে। তারা এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চান না। কর্মীদের এ অসন্তোষের মুখে গুগল পেন্টাগনের সঙ্গে চুক্তি নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
গত বছর আগস্টে চীনে সেন্সরড সার্চ ইঞ্জিন চালুর সিদ্ধান্ত ঘিরে তীব্র কর্মী বিক্ষোভের মুখে পড়ে গুগল। এ নিয়ে কর্মীরা গুগলের কাছে একটি প্রতিবাদপত্র জমা দেয়। সেখানে ১ হাজার ৪০০ জন কর্মী সই করেছিলেন।