বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশে অনলাইনে কেনাকাটার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ডেলিভারি। ক্রেতার কাছে পূর্বোল্লিখিত সময়ের মধ্যে, পণ্যের মান ঠিক রেখে পণ্য ডেলিভারি করা যে কতটা চ্যালেঞ্জিং তা ছোট, বড়, মাঝারী সব ধরণের ই-কমার্স ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো জানে। ছোট ছোট উদ্যোক্তা বিশেষ করে ফেসবুক-ভিত্তিক নারী ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের জন্যে এটা আরো চ্যালেঞ্জিং। একদম ক্রেতার বাসায় বা বাসার কাছে কোথাও পণ্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পৌঁছে দেয়া এটাকে ই-কমার্স ব্যবসার ভাষায় বলা হয় Last Mile Delivery। আমাদের দেশে এই লাস্ট মাইল ডেলিভারি অবকাঠামো খুবই অনুন্নত। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট এর মতো বড় বড় শহরগুলোতে সেটা করা গেলেও জেলা বা গ্রাম পর্যায়ে এখনো সেরকম উন্নত লাস্ট মাইল ডেলিভারি ব্যবস্থা নেই। তার উপরে গত বছর কোভিড-১৯ অতিমারিতে অনলাইনে কেনাকাটা বৃদ্ধি পেলেও এটা আরো বড় সমস্যার সৃষ্টি করেছে পণ্য ডেলিভারি করার ক্ষেত্রে কারণ অনেকে এখন অনলাইনে অর্ডার করছে যার ফলে ডেলিভার প্রতিষ্ঠান এবং ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের উপরেও দারুণ চাপ পড়েছে।
এখন আমাদের দেশে পণ্য ডেলিভারি করার যে অবকাঠামো সেটা রাতারাতি বদলাবে না, অনেক সময় লাগবে। কম করে হলেও পাঁচ ছয় বছর তো লেগে যাবেই। এখন যারা ছোট ছোট ই-কমার্স উদ্যোক্তা আছেন তারা কি বসে থাকবেন? অবশ্যই না। ডেলিভারির এই সমস্যাকে জয় করার জন্যে তাদের নানাভাবে চেষ্টা করতে হবে আর সেটাই করেছেন রাজিব আহমেদ । তার আইডিয়া হচ্ছে হচ্ছে কাস্টমার মিটআপ আয়োজন করা।
ক্রেতার আস্থা অর্জন হচ্ছে মিট-আপের সবচেয়ে বড় শক্তিঃ
দিন শেষে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতির কারণে ইন্টারনেটে যোগাযোগ করা এখন অনেক সহজ। এই অগ্রগতির পরেও মুখোমুখি বসে সরাসরি কথা বলার যে গুরুত্ব সেটা কিন্তু কমে যায় নি। সরাসরি কথা বলার ক্ষেত্রে অনেক কিছু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বোঝা যায়। এটাই হচ্ছে মিটআপের মূল কথা। এর ফলে মানুষে মানুষের সম্পর্ক আরো উন্নত হয়। এটা সত্যি যে অনলাইনে অর্ডারকৃত পণ্য ডেলিভারি করার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা হয়। কিন্তু ক্রেতা যদি এটুকু বুঝতে পারেন যে বিক্রেতা তার সেবা প্রদানের ব্যাপারে আন্তরিক, তাকে ঠকাবে না, তাহলে ডেলিভারিতে একটু সমস্যা হলেও ক্রেতা কিন্তু সেই বিক্রেতার কাছে পণ্য অর্ডার করার ব্যাপারে দ্বিধাবোধ করবেন না। তার চেয়ে বড় কথা ক্রেতার বিশ্বস্ততা অর্জন করা গেলে তিনি অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করতেও দ্বিধা বোধ করবেন না। এক্ষেত্রে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (বিকাশ, রকেট, নগদ ইত্যাদি), কার্ড বা যে কোন পদ্ধতিতে ক্রেতা মূল্য পরিশোধ করে দেবে মানে উদ্যোক্তাকে ক্যাশ টাকা হ্যান্ডেল করার ঝামেলা পোহাতে হবে না। এই ব্যাপার গুলো কাস্টমার মিটআপ এর মাধ্যমে অর্জন করা যায়।
ক্রেতারা আরো উৎসাহিত হবেনঃ
বিরাজমান ক্রেতা (Existing Customer) অর্থাৎ ইতিমধ্যে যারা সেই ই-কমার্স উদ্যোক্তার কাছে থেকে পণ্য ক্রয় করেছেন তাদের সাথে উদ্যোক্তা মুখোমুখি কথা বলছেন, ক্রেতাদের কাছে থেকে উদ্যোক্তা তার পণ্যের ফিডব্যাক নিচ্ছেন। এতে করে উদ্যোক্তা বুঝতে পারবেন ক্রেতারা কি চায়। ক্রেতারাও খুশি হবেন যে সেই ই-কমার্স উদ্যোক্তা তাদের চাহিদা পূরণে আগ্রহী। তাই তারাও ভবিষ্যতে উক্ত ই-কমার্স উদ্যোক্তার কাছে থেকে পণ্য কিনতে আরো উৎসাহী হবেন।
নতুন ক্রেতা তৈরি হবেঃ
এছাড়াও অনেকে এই মিট আপে আসবেন যারা সেই উদ্যোক্তার কাছে থেকে পণ্য কেনেন নি কিন্তু তার পরিচিত কেউ কিনেছে এবং তাদের সাথে তারা সেই মিট আপে এসেছে। মিট-আপে এসে তারা বিক্রেতার কথা শুনে তার আন্তরিকতা ও চেষ্টা দেখে তার কাছে থেকে পণ্য কিনতে আগ্রহী হয়ে উঠল। অর্থাৎ উদ্যোক্তা কিন্তু নতুন ক্রেতা তৈরি করতে পারছেন।
শেষ কথাঃ
ই-কমার্স নিয়ে আপ্নারা যারা পড়াশুনা করছেন, বিভিন্ন কোর্স করেছেন, তারা Customer Acquisition এবং Customer Retention এই দুটো বিষয় সম্পর্কে অবহিত আছেন। কিভাবে একটা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান নতুন ক্রেতা আকৃষ্ট করতে পারে এটাকে বলা হয় Customer Acquisition। সেই ক্রেতাকে কিভাবে ধরে রাখতে পারে যাতে সে যেন আবার সেই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কিনতে উৎসাহিত হয়। একে বলা হয় Customer Retention। বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো Customer Acquisition এবং Customer Retention এর জন্যে অনেক টাকা খরচ করে, বিভিন্ন ধরণের ডিজিটাল এবং অফলাইন বিজ্ঞাপন, ই-মেইল, সোশ্যাল নেটওয়ার্কে যোগাযোগ সহ অনেক কিছু করে থাকে। একটা উদাহারণ দেই। আমি শেষ নাপিতের দোকানে গিয়ে চুল কেটেছিলাম ২০২০ সালের মার্চ মাসের শুরুর দিকে। এরপরে কোভিড-১৯ অতিমারি শুরু হবার পরে ভয়ে আর চুল কাটাতে যাই নি। আমি যেটা করেছি Daraz থেকে একটা হেয়ার ট্রিমার কিনেছি। এই কেনাটাই ছিল অনলাইনে আমার প্রথম কেনাকাটা। এখনো আমি এই ট্রিমার দিয়েই চুল কাটি। এখন এই হেয়ার ট্রিমার কেনার সময়ে দারাজ ডট কম এ আমি আমার ইমেইল ঠিকানা দিয়েছিলাম। এরপরে আমি আর কোন কেনাকাটা করিনি কিন্তু দারাজ ডট কম এখনো নিয়মিত আমার ইমেইলে তাদের বিভিন্ন সেলস প্রমোশন, অফার ইত্যাদি পাঠায়। এর কারণ হচ্ছে তারা চেষ্টা করছে আমি যাতে আবার আবার দারাজ ডট কম থেকে যাতে আরো পণ্য ক্রয় করতে উৎসাহিত হই।
এখন দারাজ ডট কম বড় কোম্পানি বলে এটা করতে পারে কিন্তু ফেসবুক ভিত্তিক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পক্ষে এত কিছু করা সম্ভব না কারণ তাদের নিজেদেরকে অনেক কিছুই করতে হয়। তার উপরে তাদের এত টাকা-পয়সা নেই। এমন সব উদ্যোক্তাদের Customer Acquisition এবং Customer Retention করার ক্ষেত্রে মিট আপ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আপনি একজন ছোট উদ্যোক্তা। আপনি প্রতিদিন হাজার হাজার কাস্টমারের কাছে পণ্য বিক্রী করেন না। আপনার কাস্টমারের সংখ্যা সীমিত। কিন্তু আপনি যদি এই সামান্য কয়েকজন কাস্টমারকে ধরে রাখতে পারেন, তাদের আস্থা অর্জন করতে পারেন তাহলেও আপনি অনেক লাভবান হবেন। এটা করার ক্ষেত্রে কাস্টমার মিট-আপ হচ্ছে অব্যর্থ ওষুধ। একদিন মিটআপ হবে। প্রতিদিন করতে হবে না। খরচ কম কিন্তু এই খরচের বিনিময়ে উদ্যোক্তা যেই রিটার্ণ পাবে সেটা বিশাল। এই জন্যে রাজিব ভাই কাস্টমার মিটআপ এর জন্যে সবাইকে উৎসাহিত করেন।
লেখক
এস এম মেহেদি হাসান