আজ ১১ই জ্যৈষ্ঠ ,১৩২৮ বঙ্গাব্দ, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের জন্মবার্ষিকী। কবি কাজী নজরুল ইসলাম, এক নামেই যাঁকে সমগ্র বিশ্বের সাথে পরিচিত করিয়ে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু, তাঁর পরিচয় অগণিত; তিনি বিদ্রোহী কবি, তিনি মজলুমের কবি, তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। শুধু কি তাই? কখনো তিনি ধূমকেতুর মতো অদম্য , কখনো শিশুদের মতোই কোমল, কখনো তাঁর বিরহ কাতরতা ছুঁয়ে যায় কোটি পাঠকের প্রাণ , কখনো তাঁর বিদ্রোহে ফুটে উঠে অন্য রকম এক ভালোবাসা। বাংলায় বিদ্রোহের কবিতা লিখে তাঁর সমসাময়িক সময়ের বাংলা সাহিত্যে প্রথম বন্ধন ভেঙেছিলেন তিনিই।
একদিকে যেমন অকুন্ঠ ভাবে সত্য আর ন্যায়ের বাণী বিদ্রোহের স্বরে ব্যাক্ত করেছেন, তেমনি অন্য দিকে তিনি ভালোবাসা ছড়িয়ে দিয়েছেন মানুষের মাঝে, মানুষের জন্য। তাঁর রণ শিঙ্গা বেজেছে লোভ-অন্যায়ের বিরুদ্ধে, তাঁর কোমল বাঁশির সুর ছড়িয়ে পড়েছে নিপীড়িত-অসহায় মানুষের বুকের মধ্যে, ক্ষতের উপর পড়েছে প্রলেপ। মানবতার এক মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি।যেকোনো অসহায় মানুষকে তিনি নিজের ভাই মনে করতেন, তাঁর কাছে ধর্ম-বর্ণ-জাত কোনো ফারাক রাখে না। তিনি বিশ্বাস করেন_ ” সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর না!” নারীদের তিনি পুরুষদের তুলনায় কোনো অংশে কম মনে করেননি কখনো । বরং তিনিই প্রথম মুক্ত কন্ঠে বলতে পেরেছেন_ ” বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যানকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
একই ভাবে তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রকাশও ঘটেছে তাঁর লেখনীতেই। নিজের গান কিংবা কবিতায় কখনো তিনি জয়ন্ত অর্থাৎ মহাদেব শিবের রূপ ধরেছেন, সেই তিনিই কখনো আবার খোদা ভক্ত বান্দা, তিনি জাতের উঁচু-নিচুতে বিশ্বাস রাখতেন না। তিনি শুধুই মানব ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। এর জন্য তাঁকে কম কথা, কম আঘাত পেতে হয়নি। তবুও সকল ঝঞ্ঝার মাঝেও তিনি নিজের আদর্শকে তুলে ধরে সমান খাড়া ছিলেন।
# “আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।
আমি ইন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর রণ-তূর্য।।”
কাজী নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে (জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ)। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে মসজিদের মুয়াজ্জিন কাজী ফকির আহমদ এবং তাঁর স্ত্রী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। নজরুলের জন্মের আগে তাঁর বেশ কয়েকজন ভাইবোন মারা যায়, তাই নজরুল হওয়ার পর তাঁর ডাক নাম দেওয়া হয়েছিল “দুখু মিয়া”। নয় বছর বয়েসে তাঁর বাবা মারা যান, ফলে তাঁকে জীবিকার সন্ধানে নেমে পড়তে হয়। এর আগ অবধি তিনি স্থানীয় মক্তবে পড়াশোনা করতেন। যদিও সেখানে পরতে তাঁর একটুও ভালো লাগতো না! নজরুল ওই মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে সেই মক্তবেই শিক্ষকতা করতে শুরু করেন।পাশাপাশি মসজিদের “মুয়াযযিন” হিসেবে কাজ শুরু করেন। অল্প বয়সেই ইসলামের এই আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পাওয়ায় পরবর্তীতে তার সাহিত্যকর্মে বিপুলভাবে এগুলোর প্রভাব লক্ষ করা গেছে।
কিন্তু, তাঁর ঐ কাজে বেশিদিন ভালো লাগেনি। তিনি বরাবরই একটু বাউন্ডুলে এবং ভ্রমণপিয়াসু ছিলেন। একই স্থানে একই কাজে তাঁর ভালো লাগতো না। কিন্তু একটা বিষয়ে তিনি দারুণ আগ্রহী ছিলেন,সেটা হলো “সাহিত্য” বিশেষত কবিতা এবং গান রচনায় তিনি বাল্যকাল হতেই সিদ্ধহস্ত!
তাই নিজেকে সেই মতো তৈরি করার লোভে বাংলার রাঢ় অঞ্চলের এক ভ্রাম্যমান নাট্যদলে অর্থাৎ লেটোর গানের দলে পালিয়ে গিয়ে যোগদান করেন। তার চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের একজন উস্তাদ ছিলেন,তিনি আরবি,বাংলা,ফারসি ইত্যাদি মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন। ধারণা করা হয়,এই চাচার প্রভাবেই নজরুল লেটো দলে যোগ দিয়েছিলেন।
সেই দলের সাথে সাথে তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, মেলায় যেতেন আর তাদের থেকে অভিনয়, গান ও নাচ প্রভৃতি শিখতেন। কখনো কখনো নাটকের জন্য তিনি নিজেও গান ও কবিতা লিখে দিতেন। মূলত লেটো গানের দলেই তাঁর সাহিত্য চর্চা শুরু হয়।
এই নাট্যদলে থাকাকালীন তিনি প্রচুর লোকসঙ্গীত রচনা করেন। যেমন— “দাতা কর্ণ, কবি কালিদাস, আকবর বাদশাহ, রাজপুত্রের গান, মেঘনাদ বধ, বিদ্যাভূতুম” প্রভৃতি।
এছাড়াও তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দেবী কালীকে নিয়ে প্রচুর শ্যামা সঙ্গীতও রচনা করেন সেইসময়। বিংশ শতাব্দীতে এক নতুন ধারার শ্যামা সঙ্গীত বাংলায় নিয়ে এসেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুলের শ্যামা সর্বধর্মের সমন্বয়ে গড়া, আত্মসচেতন, আমিত্ববিনাশিনীর গুণধারিণী সে। আর সেকারণে শ্যামার প্রতিফলন হয় সমাজতন্ত্রের রূপকার হয়ে।মূলত ব্রিটিশ শাসন আমলে শ্বেতাঙ্গ- শাসকদের বিনাশিনীরূপে অবতীর্ণা মহাকালীর ভাবনার প্রতিফলন দেখা যায় নজরুলের শ্যামার মধ্যে। শ্যামা সংগীতগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য_” ‘মাগো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়’, ‘শ্মশানকালীর নাম শুনে রে’, ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা ইত্যাদি।’
এর জন্য অনেক গোঁড়া মুসলিমরা তাঁকে কাফের বলেছিলো। কিন্তু নজরুল পিছু হটেননি। তিনিই আবার ইসলামনির্ভর কবিতা ও গজল লেখার সূত্রপাতও করেছিলেন।অর্থাৎ, তিনিই প্রথম বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার চর্চা শুরু করেছেন বলা যায়। আসলে তিনি ধর্মীয় কুসংস্কার এবং গোঁড়ামিগুলো দূর করার জন্য সবসময়ই অবিচল ছিলেন। এজন্য বারবার তাঁর উপর আঘাতও এসেছে,তবে তাঁকে দমাতে পারেনি।
পরবর্তীতে এ বিষয়ে তিনি একটি কবিতা রচনা করেন যার নাম দেন_ “আমার কৈফিয়ত “। এই সম্পূর্ণ কবিতায় কবি নজরুল ইসলাম তাঁর সমস্ত বিদ্রোহের কারণ ব্যাখ্যা করে গেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে সকলের আনা অভিযোগের জবাব দিয়ে গেছেন।
এই কবিতা পড়লে নিশ্চিত ভাবেই প্রমাণিত হয় তাঁর কাছে সবার আগে মানবতা আর অসাম্প্রদায়িকতাই প্রাধান্য পেয়েছে। ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানের কারণে এবং এই বিষয়গুলোকে মূল উপজীব্য করে তাঁর লেখা কবিতা “বিদ্রোহী”—কে বিবেচনা করে তাঁকে “বিদ্রোহী কবি” হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়।
১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। প্রথমে ভর্তি হন রাণীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল, এরপর মাথরুন ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে যা পরবর্তীতে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিতি লাভ করে। আর্থিক সমস্যা তাকে বেশি দিন এখানে পড়তে দেয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যান । প্রথমে যোগ দেন কবিয়াল বাসুদেবের কবিদলে। এর পর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা হিসেবে কাজ নেন তিনি। সেখান থেকে বেরিয়ে আসানসোলের এক চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন।
এই দোকানে কাজ করার সময় একা একা বসে নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখেন আসানসোলের থানার দারোগা রফিজউল্লাহ। সেগুলো দেখে তিনি নজরুলের ভিতরে থাকা অসামান্য প্রতিভার পরিচয় পান। তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণী থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করেন।
এরই মধ্যে বেজে ওঠে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা। মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই নজরুল ছুটে চলে যান যুদ্ধে যোগ দিতে। ১৯১৭ সালের প্রায় শেষ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর কাজী নজরুল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সৈন্য হিসাবে কাজ করেন।
প্রশিক্ষণের জন্য প্রথমে তিনি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীকালে বর্তমান পাকিস্তানের নওশেরা প্রদেশে যান। এরপর প্রশিক্ষণ শেষে তিনি করাচি সেনানিবাসে সৈনিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তখন তিনি রেজিমেন্টের পাঞ্জাবী মৌলবী সৈন্যদের থেকে ফারসি ভাষা শেখেন। এছাড়াও সঙ্গীতানুরাগী সহ সৈনিকদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্র এবং সঙ্গীতের চর্চা করেন এবং একই সঙ্গে সমানভাবে সাহিত্যচর্চাও জারি রাখেন ।
করাচির সেই সেনানিবাসে বসেই তিনি রচনা করেন অসংখ্য বিখ্যাত বই। যেমন_ “বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী, মুক্তি, ব্যথার দান, ঘুমের ঘোরে” ইত্যাদি নানা গদ্য ও কবিতাগুলো সেখানেই লেখা, যা পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
১৯২০ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে যায় এবং তিনি আবার কলকাতায় ফিরে আসেন।
শুধু কি সাহিত্যেই তাঁর দখলের জন্য তিনি স্মরনীয় হয়ে আছেন? না;নজরুল সম্ভবত ওই সময়ের প্রথম বাঙালি, যিনি বাংলার নবজাগরণের যে ঐতিহ্য সেটা ধারণ করেছিলেন এবং তার মধ্যে দিয়ে তিনি বাঙালিকে একটা শক্ত, সবল নতুন চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ।কখনও তিনি গান গাইছেন, কখনও পত্রিকা সম্পাদনা করছেন, কখনও রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করছেন, ঠোঁটকাটা সত্যি সর্ব সম্মুখে বলার অপরাধে জেল খাটছেন, বেরিয়ে আবার সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। তিনি ভাঙবেন তবু মচকাবেন না! অসির চেয়ে মসি শক্তিশালী; তাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অস্ত্র হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন লেখালেখিকে-ই।
যুদ্ধ শেষে কলকাতায় ফিরে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বাস করতে শুরু করেন। এখান থেকেই তার মূল সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের শুরু হয়। প্রথম দিকে মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত এবং প্রশংসিত হয়। আস্তে আস্তে দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমালোচকদের সাথে নজরুলের ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয়।এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন_ ” মোতাহার হোসেন, অতুলপ্রসাদ সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মেলন্দু লাহিড়ী, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়সহ আরো অনেকে”। ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে যান এবং রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে দারুণ একটা সম্পর্ক ছিল।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই থেকে ‘নবযুগ’ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক- এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন। সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান এবং ওই পত্রিকায় তাঁর একটি রাজনৈতিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে পুলিশের নজর পড়ে তাঁর উপর।
এর মাঝে নজরুলের পরিচয় হয় আলী আকবর খানের সাথে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে। ১৯২১ সালের মার্চে নজরুল আলী আকবর খানের সাথে তার দেশের বাড়ি কুমিল্লায় বেড়াতে যান। কুমিল্লা পৌছে প্রথমে নজরুলকে নিয়ে আলী আকবর খান তার স্কুলের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় উঠেন। সেই বাড়িতে তাদের আপ্যায়ন করে নেন বীরেন্দ্রকুমারের মা বিরজা সুন্দরী দেবী, তার বিধবা জেঠিমা গিরিবালা দেবী ও তার মেয়ে প্রমীলা সেনগুপ্তা ও আশালতা সেনগুপ্তাকে। চারপাঁচ দিন সেখানে কাটিয়েছিলেন কবি। তবে সেই চার পাঁচ দিনেই সেনবাড়ির সবার সাথে নজরুলের সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। নজরুল তাকে “মা” বলে ডাকতেন।
১৩২৮ বঙ্গাব্দের ৩ আষাঢ় , ওস্তাদ আলী আকবর খানের ভাগ্নি নার্গিসের সাথে কবির সাথে বিয়ের দিন ধার্য হয়। সেদিন বিয়ের আকদ্ সম্পন্ন হলেও কাবিনে ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে, নজরুল বাসর সম্পন্ন না করেই নার্গিসকে ছেড়ে দৌলতপুর ত্যাগ করেন। কবি তার ছায়ানট; পূবের হাওয়া; চক্রবাক কাব্য গ্রন্থের অনেক কবিতা এবং গান নার্গিসকে কেন্দ্র করে রচনা করেছিলেন।
দৌলতপুর থেকে তিনি আবার কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এবং সে সময় প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন।ধীরে ধীরে সে পরিচয় প্রণয়ে গড়ায় এবং এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। নজরুল এবং প্রমিলা দম্পতির চার সন্তান ছিলো। নজরুল যে সাম্যবাদের একজন অগ্রদূত ছিলেন, সেটা তাঁর চার সন্তানের নামেও প্রকাশিত হয়। তাঁর সন্তানদের নাম যথাক্রমে; “কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ”।
নজরুলের সাথে নার্গিসের দেখা হয়েছিলো প্রায় ১৫ বছর পরে। তখন তাদের আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। কবি আজিজুল হাকিমের সাথে নার্গিসের দ্বিতীয় বিয়ে সম্পন্ন হয়।
১৯২০-এর দশকের অসহযোগ আন্দোলন এক সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।এর পরপর স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের আবির্ভাব ঘটে। এই বিপ্লবকে সমর্থন করে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই আগস্ট নজরুল “ধূমকেতু” পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং একে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
“কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু।
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গ শিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।”
পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের অন্যতম একটি কবিতা “আনন্দময়ীর আগমনে” প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। এরই সাথে তার “যুগবাণী” গ্রন্থটিও বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এক জবানবন্দি প্রদান করেন। তার এই জবানবন্দি বাংলা সাহিত্যে “রাজবন্দীর জবানবন্দী” নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে। এই জবানবন্দীতে নজরুল যা বলেছেন তাতে এটা প্রমাণিত হয়েছে তিনি কখনো অসত্যের সামনে ভয়ে মাথা নোয়াবেন না। এই জাবানবন্দির একাংশে তিনি বলেছিলেন__
“আমি কবি,আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে…।”
১৬ জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। নজরুলকে নিয়ে যাওয়া হয়। আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে যখন কবি বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথ তার “বসন্ত” গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। সেই আনন্দে জেলে বসে নজরুল বিশ্বকবিকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য “আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে” কবিতাটি রচনা করেন। স্বরাজ আন্দোলনে তিনি অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান, কবিতা এবং প্রবন্ধ লিখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো_ ” এই শিকল পরা ছল, মানবতাহীন ভারত শ্মশান, দুর্গম গিরি কান্তার মরু ইত্যাদি।”
তিনি সমস্ত অন্যায় অভিযোগের প্রতিবাদস্বরূপ লিখেছিলেন বেশ কিছু কবিতা। তেমনি এক কবিতায় তিনি বলেছিলেন__
“পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!”
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার কিছু বছর আগে এই মহান কবি তাঁর বাক শক্তি হারিয়ে ফেলেন এবং এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে ক্রমশ নিমজ্জিত হতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি তাঁর মানষিক ভারসাম্য-ও হারিয়ে ফেলেন। সেই দুরারোগ্য রোগের কারণ এবং প্রতিকার আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে কাজী নজরুলের গান এবং কবিতা আমাদের দেশের মানুষকে দারুণ উজ্জীবিত করেছিলো। তাই ,স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে তারিখে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারি আদেশ জারী করা হয় এবং তাঁকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়। এরপর যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি।ঢাকার পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে এই চিরবিদ্রোহী কবি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পূর্ব ইচ্ছা অনুসারে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করা হয়।
কিন্তু আমরা জানি, তিনি আজও অশান্ত চিত্তে শায়িত আছেন এই বাঙলার মাটিতে। আজও নির্যাতিত মানুষের চিৎকার বাতাস ভারী করে দেয়, আজও এই পৃথিবীতে ধর্ম নিয়ে কদর্য খেলা চলে। চির বিদ্রোহী এই মানুষটি কি করে শান্তি পাবেন তবে? তাই তো তাঁর সমাধিতে পাথরের ফলকে এখনো মুদ্রিত আছে তাঁর রচিত সেই বিখ্যাত পঙক্তিমালা;
“মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়ুগ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাজী নজরুল ইসলামকে বর্ণনা করেছিলেন ‘ছন্দ সরস্বতীর বরপুত্র’ হিসাবে। অসহায় নির্যাতিত মানুষের বন্ধু তিনি, তিনিই অন্যায়কারীদের কাছে এক ত্রাসের নাম। হিন্দু-মুসলিম , সকল ধর্মালম্বী মানুষকে একত্রিত করার চেষ্টা করে গেছেন তিনি সারা জীবন। তাঁর জীবনের শেষ ভাষনেও তিনি বলে গেছেন মানবতার কথা, ভ্রাতৃত্বের কথা; “কেউ বলেন আমার বানী যবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।”
সারাজীবন ধরে তিনি অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন, তবুও জীবনের শেষ পর্যন্ত মানুষের পাশে থেকেছেন।কখনো এসেছেন বিদ্রোহীর বেশে , কখনো স্নেহময় হয়ে। অথচ তাঁর এতো কষ্টের কতটুকু প্রতিদান আমরা দিতে পেরেছি? কীসের ব্যাথায় তিনি লিখে গিয়েছেন__
“যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে –
বুঝবে সেদিন বুঝবে!”
আজ তাঁকে দেবার মতো কিছুই আমাদের নেই শুধু শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা ছাড়া। হে কবি, তাই দিয়ে আজ এই শুভ লগ্নে তোমায় স্মরণ করি। বারবার বেজে উঠুক তোমার বিদ্রোহের রণ ডঙ্কা, যতদিন এই পৃথিবীতে আছে অন্যায়কারীর শঙ্কাহীনতা, ততদিন তোমার অভিসম্পাত আঘাত হানুক প্রানে প্রানে। শুধু এটুকুই মিনতি তোমার কাছে__
“পথিক! ওগো অভিমানী দূর পথিক!
কেহ ভালোবাসিল না ভেবে যেন আজো
মিছে ব্যথা পেয়ে যেয়ো না,
ওগো যাবে যাও, তুমি বুকে ব্যথা নিয়ে যেয়ো না।”