কথায় আছে বাঙালী মানেই ভোজনরসিক বাঙ্গালী।আমরা সবসময় পছন্দের খাবার খেতে ভালোবাসি। প্রায় সবাই সবার মায়ের কাছে গল্প শুনি মজাদার সব খাবারের। যা আমাদের নানী দাদীরা অনেক সময় নিয়ে যত্ন করে তৈরি করতো প্রিয়জনদের জন্য।ঐসব খাবারের মধ্যে অনেক আইটেম এখন জায়গা পেয়েছে ঐতিহ্য বাহী খাবারের তালিকায়, আবার কিছু কিছু খাবার হারিয়ে গেছে বিদেশী খাবারের নামের অন্তরালে। বর্তমানে ইয়ং জেনারেশন ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো প্রায় ভুলতেই বসেছে। কেননা বিদেশী খাবারের প্রতি বর্তমানে বাচ্চা থেকে বুড়ো প্রায় সবারই ঝোঁক আছে।
ময়মনসিংহেও অনেক জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী খাবার রয়েছে।যার মধ্যে কিছু কিছু খাবার হারিয়ে যেতে বসেছে।কিন্তু মানুষ এখনো পছন্দ করে এসব খাবার এবং খেতেও চায়। যান্ত্রিক জীবনে মানুষের সময় অনেকটাই সীমিত তাই তৈরি করার সময়ও হয়তো অনেকের হয়ে ওঠে না। কিন্তু তৈরি করা অবস্থায় পেলে হয়তো অনেকে সেই খাবারগুলো খেতে আগ্রহী হবে।ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে রয়েছে –
গরুর মাংসের শুটকি -ময়মনসিংহের জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে পরিচিত গরুর মাংসের শুটকি।আগেকার দিনে নানী দাদীরা গরুর মাংসকে সংরক্ষণ করতো রোদে শুকিয়ে শুটকি তৈরি করে।গরুর মাংসের শুটকি এই অঞ্চলের প্রতিটা ঘরের স্পেশাল খাবার হিসেবে পরিচিত।আগে রেফ্রিজারেটরের সুবিধা না থাকায় কোরবানির মাংসগুলো দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে রাখা সম্ভব হতো না, তাই হলুদ মাখিয়ে রোদে শুকিয়ে তৈরি করা হতো শুটকিগুলো।আবার অনেকেই হলুদ দিয়ে হালকা সেদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে শুটকি তৈরি করে সংরক্ষণ করতো দীর্ঘদিন। গরুর মাংসের মতো করেই রান্না করা হয় এগুলো, শুধু রান্নার ৬/৭ ঘন্টা আগে ভিজিয়ে রেখে এরপর পাটায় ছেঁচে নিতে হয়। ময়মনসিংহের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিতে গরুর মাংসের শুটকি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রয়োজন শিক্ষিত ও ডেডিকেটেড উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসা ও প্রচার করা।
চ্যাপার পুলি -চ্যাপার পুলি ময়মনসিংহ অঞ্চলের স্পেশাল খাবার হিসেবে পরিচিত।আত্মীয়স্বজন আসলেও টেবিলে অন্যান্য আইটেমের সাথে চ্যাপার পুলি প্রাধান্য পায়। চ্যাপার পুলি তৈরি করতে প্রয়োজন হয় চালকুমড়া পাতা, চ্যাপা ও পেঁয়াজ,রসূন,তেল,লবন, মরিচ। চ্যাপাগুলোকে পেঁয়াজ মরিচ রসূন, লবন ও তৈল দিয়ে ভূনা করে পুর বানিয়ে চালকুমড়া পাতার মধ্যে একটু একটু পুর দিয়ে পাতাগুলো ভাঁজ করে নিতে হয়।এরপর হালকা আঁচে মুচমুচে করে ভেজে নিতে হয় পুলিগুলো।
এই পুলিগুলো ডিপ ফ্রিজে রাখলে এক দেড় মাস পরেও খাওয়া যায়।
ই-কমার্সে ময়মনসিংহের এই ঐতিহ্যবাহী খাবারের পরিচিতি করা অনেকটাই সহজ হতে পারে কিন্তু ডেলিভারি দেওয়া অনেকটা চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু চ্যাপাকে ময়মনসিংহের পণ্য হিসেবে ই-কমার্সের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।
মিডুড়ী -ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী খাবার হলো মিডুড়ী।মিডুড়ী হলো এক প্রকার মিষ্টান্ন। কিন্তু বর্তমানে এই মিষ্টান্ন বিলুপ্ত প্রায়। বিয়ে,মৃত্যু ব্যক্তির জন্য মিলাদে,বিশেষ কোনো উৎসব অনুষ্ঠানে রান্না করা হতো মিডুড়ী।চালের গুড়া,কুড়ানো নারিকেল,সাগুদানা,গুড়,কিসমিস দিয়ে তৈরি করা হতো এই মিষ্টান্ন। যা উৎসবের খাওয়া দাওয়ার শেষে ডেজার্ট হিসেবে খাওয়া হতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে পায়েস ও ফিরনী জায়গা নিয়েছে এবং মিডুড়ীর নামটা অনেক ভুলেও গেছে।
বর্তমান সময়ে ই-কমার্সের বদৌলতে রান্না করা পায়েস যেমন উদ্যোক্তারা বিক্রি করতে পারছে তেমনি মিডুড়ীও তার হারিয়ে যাওয়া নামটি আবারো ফিরে পেতে পারে উদ্যোক্তাদের প্রচারণার মাধ্যমে।
খুদের ভাত -ময়মনসিংহের মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয় একটি খাবার হলো খুদের ভাত।হরেক রকম ভর্তা দিয়ে খাওয়া হয় এই ভাত গুলোকে। কোনো কোনো এলাকায় একে বৌখুদও বলে থাকে। ধান ভাঙ্গানোর সময় ছোট ছোট চালের ভাঙ্গা কণা বের হয়। সেগুলোকে পরিস্কার করে পোলাওয়ের মতো করে রান্না করা হয় খুদের ভাত। খেতে অসাধারণ লাগে। বর্তমানে ই-কমার্সের বদৌলতে খুদের ভাত আবার জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রতিটা মানুষের কাছে এই খাবার অমৃতের মতো।
চাল কুমড়ার মুরব্বা-
শীত কাল আসার আগে আগে একসময় গ্রাম অঞ্চল কিংবা শহরাঞ্চল সববাড়িতেই তৈরি হতো পাকা চাল কুমড়ার মুরব্বা।চাল কুমড়ার সিজন শেষ হলে পাকা যে চাল কুমড়াগুলো থাকতো সেগুলোকে মানুষ মুরব্বা করে খেতো। পাকা চাল কুমড়াগুলো গুল গুল করে কেটে খেজুর কাঁটা বা কাঁটাচামচ দিয়ে থেতলে নেওয়া হতো। এরপর সেগুলো চিপে চিপে পানি বের করে পাতলা পরিষ্কার কাপড়ে রেখে জুলিয়ে রাখা হতো অবশিষ্ট পানিটুকু ঝড়ে পরার জন্য। এরপর সেই পানি ঝড়ানো চালকুমড়া গুলো হালকা তেলে ভেজে চিনি ভেজানো দুধে সারারাত ভিজিয়ে রাখা হতো।অনেকে আবার দুধে কুড়ানো নারিকেলও ব্যবহার করেন।
ই-কমার্সের মাধ্যমে এই খাবারের চাহিদা তৈরি করা সম্ভব। কারন অন্তত নিজ এরিয়াতে এই খাবার ডেলিভারি দেওয়া সম্ভব আবার প্রচারের মাধ্যমে চাহিদাও বাড়তে পারে। খাবারের উদ্যোক্তারা নিজেদের ম্যানুতে এই খাবারকে রাখলে ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাবে।
কবাক -ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী খাবার কবাক।কবাক নামটা এখন প্রায় হারিয়েই গেছে এখন আর কবাক রান্না করা হয়না প্রতিটা ঘরে ঘরে। কবাক রান্না করা হয় দেশী মোরগ দিয়ে। দেশী মোরগের চামড়া ছাড়িয়ে পরিস্কার করে নেওয়া হয় এরপর সেই আস্ত মোরগ শিকে ডুকিয়ে আগুনে পুরা হতো, তারপর সেই মোরগকে ঢেকিতে কোটে তৈরি করা হতো কিমার মতো করে এরপর সেগুলো কাঁচামরিচ, পেয়াঁজ ও আদা দিয়ে মাখিয়ে নেওয়া হতো। অবশেষে সরিষা তৈল মেখে গুটাপিঠা বা গরম গরম ভাতের সাথে খাওয়া হতো। অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার বলে বর্তমানে মানুষ এই খাবার তৈরি করে না। কিন্তু মানুষের খাওয়ার আগ্রহ কমেনি, যদি উদ্যোক্তারা এই খাবারকে নিয়ে বিভিন্ন ভাবে কনটেন্ট তৈরি করে তাহলে সহজেই এর চাহিদা বাড়তে পারে।
লাউয়ের টক খাটাই -ময়মনসিংহের মানুষের কাছে লাউয়ের খাটাই ছিলো একসময়ের চাহিদা সম্পন্ন খাবার।আগেকার দিনে শীতের শেষের দিকে শীতলাউগুলো একটু বেশীই পোক্ত হয়ে যেতো, আবার অনেকেই লাউগুলোকে পোক্ত করতো শুধু খাটাই খাওয়ার জন্য। কিন্তু বর্তমান জেনারেশন এই লাউয়ের খাটাই চিনে বলে মনেই হয়না। একটু পোক্ত
হয়ে যাওয়া লাউ কেটে এরসাথে তেতুল বা শুকনা বড়ই দিয়ে সেদ্ধ করতো তারপর সেদ্ধ হয়ে গেলে ডালের গুটনি দেয়ে ঘুটে এরসাথে আঁখের গুড় মিশিয়ে আরো কিছুক্ষন সেদ্ধ করা হতো। সবশেষে পাঁচফোড়ন,শুকনা মরিচ ও তেজপাতা দিয়ে ভাগার দেওয়া হতো। ভাত খাওয়া শেষে একটু ভাতের সাথে টক মিষ্টি ঝাল স্বাদের লাউয়ের খাটাই তখনকার মানুষের কাছে অমৃত মনে হতো। কিন্তু এখন আর তেমন কেউ এই খাটাই তৈরি করে না, ফলে হারিয়ে যাচ্ছে এর ঐতিহ্য।
ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো তৈরি করতে হলে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যান্ত্রিক এই জীবনে সময়টা যেনো সোনার হরিণের মতো।তবে যেহেতু আমরা ভোজন রসিক তাই খাবার তৈরি করার সময় খুব একটা না পেলেও খেতে পছন্দ করি। তাই অনেক সময় আমরা নির্ভর হয়ে পরি ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের উপর।দেশীয় ঐতিহ্যবাহী খাবার গুলোকে হারিয়া যাওয়া থেকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন ই-কমার্স উদ্যোক্তা তৈরি হওয়া এবং ডেডিকেটেড ভাবে কাজ করা।
তাছাড়া ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো নিয়ে প্রতিবছর সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে হতে পারে মেলা। যে মেলাতে শুধু দেশীয় ঐতিহ্যবাহী খাবার গুলোর প্রদর্শনী থাকবে এবং মানুষের কিনে খাওয়ার সুযোগ থাকবে। ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সহজেই পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাবে এসব আঞ্চলিক খাবারের সাথে।
আবার বর্তমান সময়ে ইয়ং জেনারেশন রেস্টুরেন্ট মুখী তাই রেস্টুরেন্ট মালিকরাও এমন কোনো উদ্যোগ গ্রহন করতে পারে যে তাদের ম্যানুতে আঞ্চলিক ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো যুক্ত করতে পারে। ফলে সবার কাছে ঐতিহ্যবাহী খাবার গুলো পরিচিতি পেতে থাকবে নতুনভাবে।