টাঙ্গাইল এর ইতিহাস অতি প্রাচীন। আমরা টাঙ্গাইল বলতে তাঁত এর শাড়ি এবং পোড়বাড়ীর চমচম বুঝলেও কাগমারীর কাঁসা ও পিতল শিল্প বিশ্ববাজারে টাঙ্গাইল কে করেছে সমাদৃত। কাঁসা ও পিতল এর নাম আসলে টাঙ্গাইল জেলার নামটি চলে ই আসে৷
কাঁসা ও পিতল শিল্প এতটা ই প্রসিদ্ধ শিল্প ছিলো আমাদের টাঙ্গাইল এর যে এখান থেকে ভারতবর্ষের প্রতিটি জেলা মহকুমায় পর্যন্ত পৌঁছে যেত এখানকার পণ্য৷ অবিভক্ত বাংলায় টাঙ্গাইল এর কাঁসা পিতল এতটাই প্রসিদ্ধ ছিলো যে তা ভারত উপমহাদেশের চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য দেশেও রপ্তানি হতো।দেশ ভাগের সময় বহু কর্মকার ভারতে পাড়ি জমালে ও এখন ও কাগমারী এলাকায় অনেক কর্মকার পরিবার আছে।
একটা সময় গৃহস্থালীর কাজের জন্য কিংবা অন্যান্য অনেক প্রয়োজনেও ব্যবহার করা হতো কাঁসা পিতলের পণ্য। ছোট বেলায় দাদু কে দেখতাম দাদুর একটা প্লেট ফিক্সড ছিলো তা হলো কাঁসার। দাদুর জগ, মগ, বদনা সব ই ছিলো কাঁসার। আমার এত ভারী লাগতো যে ভালো লাগলে ও নিতাম না আমি কখনো ই। কিন্তু দাদু ওসব ছাড়া ব্যবহার করতেন না। শুনেছিলাম দাদাভাই এর স্মৃতি মিশে ছিলো সেসবে। দাদা ব্যবহার করতেন, যেহেতু দাদা অনেক আগে ই মারা গেছেন তাই সেগুলো দাদু সব সময় নিজে ই ব্যবহার করে গেছেন।
নানু কে ও দেখেছিলাম সুন্দর পান ছেচনী ছিলো। দাদু, নানু বা পরিবারের কারো না কারো কাঁসা পিতলের সাথে এমন স্মৃতি মনে হয়ে আমাদের বেশির ভাগ মানুষের ই আছে। আসলে আমাদের দেশে কাঁসা র তৈজসপত্র গুলো এতটা ই জনপ্রিয় ছিলো এক সময়।
আগে প্রসিদ্ধ পরিবারগুলো তে কাঁসা পিতলের তৈজসপত্র ই ব্যবহৃত হতো। বিবাহ, সুন্নাতে খাতনা, মুখে ভাত, অন্নপ্রাসন্ন, জন্মদিন, আকীকা সব অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে দেয়া হতো কাঁসা পিতলের পণ্য৷ এমনকি এই উপহার কে খুব দামী উপহার হিসেবে গণ্য ও করা হতো৷ হিন্দুদের বিয়ে, পূজো বা বিভিন্ন রীতিতে ব্যবহার করা হয় কাঁসা পিতল এর তৈজসপত্র। অথচ এখনকার প্রজন্ম হয়তো কাঁসা পিতল দেখেনি কিংবা এমন পণ্য হয় তাই হয়তো জানেনা। এটা আমাদের জন্য অনেক বেশি দুঃখজনক।
কাঁসা পিতলকে দেখতে এক কালার জন্য আমরা অনেক সময় ই একে এক ভেবে ভুল করি। আসলে কাঁসা হচ্ছে রাং বা টিন( Tin) এবং তামা (Copper) এর সংমিশ্রণ এ তৈরি একটি মিশ্র ধাতু। পিতল আর কাঁসা কিন্তু দুইটা ভিন্ন জিনিস। পিতল হলো দস্তা (zinc) এবং তামা (copper) এর সমন্বয়ে তৈরি একটি
ধাতু।।।
আমাদের দেশেই বিশেষ কিছু জায়গায় এই কাঁসা পিতল দিয়ে তৈরি হয় অসংখ্য সুন্দর সুন্দর জিনিসপত্র, বিভিন্ন মূর্তি সহ অনেক কিছুই। যে বিশেষ মূর্তি বা পণ্যটি তৈরি হয় তার একটি অবয়ব আগে তৈরি করে নেয়া হয় মোম দিয়ে । মোমের প্রলেপ এর উপর সুন্দর করে কারুকাজ করা হয়, যেমনটি চান একজন কর্মকার। এরপর তার উপর তিন স্তরে মাটির প্রলেপ দেয়া হয়। পরবর্তী তে তা পোড়ানো হয় যার ফলে মোম গলে আসে এবং মাটির ছাচ এ তৈরি হয় মোম এর ঐ ডিজাইন এর প্রতিবিম্ব। এরপর মাটির সেই ছাচে তামা ঢুকিয়ে তৈরি করা হয় মূর্তিগুলো৷ যেকোন ডিজাইন তুলতে পারে কর্মকার রা। তামা, পিতল এর যেকোন কিছুর প্রলেপ দিয়ে মূর্তিটি হয়ে উঠে অনিন্দ্য সুন্দর।
কয়েক হাজার বছর আগে থেকে ই আমাদের টাংগাইল এর সাথে কাঁসা পিতলের সম্পর্ক পাওয়া যায়। যখন মোঘল সাম্রাজ্য ছিলো, সেই সময় থেকে উপমহাদেশে কাঁসার ব্যবহার শুরু হয়। রাজা গৌড় গোবিন্দের শাসনামলে উপমহাদেশে ভারতের কংস বণিকদের মাধ্যমে এই দেশে কাঁসা শিল্পের প্রচলন শুরু হয়। সেই সময় এসব ধাতু দিয়ে ঢাল, তলোয়ার, তীর, ধনুক সহ বিভিন্ন রকম যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরি হতো৷ এরপর আস্তে আস্তে এখানে পিতল, তামার ব্যবহার শুরু হতে থাকে।
এমন কি ব্রিটিশ শাসনের সময়ে ও বাংলায় এই শিল্পের ব্যাপক বিস্তৃতি ছিলো। বাংলার ঘরে ঘরে তখন কাঁসা পিতলের ব্যবহার ছিলো চোখে পরার মত। টাংগাইল এর কাগমারী এলাকা ছিলো কাঁসা পিতলের জন্য বিখ্যাত৷ এমন কি ব্রিটিশ সরকার তখনকার সময়ে ই কাঁসা র তৈরি তৈজসপত্রে এত মনোমুগ্ধকর নকশা দেখে অনেক কর্মকারকে ই পুরস্কার এ ভূষিত করেছিলেন। যেসব ব্যক্তিরা লোহা, সোনা, তামা, রূপা, পিতল,কাঁসা নিয়ে কাজ করে তাদের বলা হয় কর্মকার। সেই সময় গুলোতে টাংগাইল এ কে কত ঝকঝকে কাঁসার জিনিস বানাতে পারে তার প্রতিযোগীতা হতো।
আগেকার সম্ভ্রান্ত পরিবার, রাজা বাদশাহ রা এই জিনিসগুলো এত ব্যবহার করতেন এবং এত খুশি হতেন কর্মকার দের উপর যে কর্মকার রা ও নিত্য নৈমত্তিক এসবের মাঝে নিজের মনের মাধুরি মিশিয়ে নকশা তৈরি করতেন। কিন্তু এখন সেই লোকবল ও নেই যে কর্মকারদের উৎসাহিত করবে।
কর্মকারদের সুনিপুন হাতের তৈরি নকশা এবং গুনগত মানের জন্য কাঁসা উপমহাদেশে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং কাঁসা পিতলের প্রসিদ্ধ জায়গা টাংগাইল এর কাগমারী খুব ব্যবসাসফল একটা জায়গা হিসেবে সুপরিচিত ছিলো। একটা সময় ছিলো যখন টাংগাইল এর কাগমারী, মগরা এলাকায় দেড়শোর অধিক কারখানা ছিলো, সেখানে কাজ করতো হাজার এর মত কর্মকার। সেই সময় রাত দিন এসব এলাকায় কাঁসা পেটানোর শব্দ পাওয়া যেত কিন্তু কাঁসার ব্যবসার এত খারাপ অবস্থা যে তাদের অনেকেই অন্য পেশায় চলে গেছে, অনেকেই খুব অভাবের মাঝে ই দিনাতিপাত করছে। এমন কি পুরো এলাকা জুড়ে এখন মাত্র ৪টি পরিবারে এসব তৈরি হয়। টাংগাইল শহরে কয়েকটা কাঁসার দোকান আছে তবে তাতেও ক্রেতা খুব ই কম।
পিতলের সংকট, কয়লা সংকট, মেডিসিন সংকট, এসব বিভিন্ন কারণে তারা কর্মকার রা এগুতে পারছেনা। গুটিয়ে যাচ্ছে এ ব্যবসা। প্রয়োজনীয় আধুনিক কোন সরঞ্জামাদি র ছোয়া পায়নি এ শিল্প। সম্পূর্ণ হাতের ছোয়ায়, কাঁচামাল এর সরবরাহ কম এবং তার দাম এত বেশি যে উৎপাদিত পণ্যের দাম ও বেড়ে যায়, যার কারণে ক্রেতা এত দামী জিনিস কিনতে চায়না। এছাড়া ও এখন মেলামাইন, এলুমিনিয়াম, প্লাস্টিক, কাঁচ, স্টীল এর জিনিস এত সহজলোভ্য হয়েছে যে তার জায়গায় কাঁসা পিতলের ভাবনা টা মানুষের কাছে সৌখিনতা বলে ই মনে হয়।
টাংগাইল এ কাগমারীতে এখন ও দেখা মেলে অনেক কর্মকার পরিবারের। কিন্তু ব্যবসার এমন খারাপ সময় যে তারা তাদের পূর্বপুরুষের হাতে গড়া এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে পারবে কি না সন্দীহান। এত সুন্দর হাতের কাজ যাদের তারা আয় রোজকারের জন্য এ পথ ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে বিভিন্ন গার্মেন্টস কিংবা অন্যান্য পেশায়। আবার মহাজন ভিত্তিক এসব ব্যবসায় কর্মকার রা পাচ্ছে না নিজেদের সঠিক পারিশ্রমিক, পাচ্ছেনা ভালোভাবে দিনাতিপাত করার সুযোগ। অনেক কর্মকার তো নিজেরা কাঁচামাল এর এত দাম এর জন্য না কিনতে পেরে মহাজনদের কাছে থেকে আসা ভাংড়ি জিনিস ঠিক করেন বা ঝকঝকে করেন, তা দিয়ে যা আসে তাতেই টুকটাক সংসার করেন।
তবু ও কর্মকাররা এখন ও তাদের হাতের জাদুর ছোঁয়ায় তৈরি করে চলেছে কাঁসা পিতলের প্লেট, চা কাপ, ঘটি, বাটি, চামচ, জগ, গ্লাস, বদনা, ঝারি, মোমদানী, ফুলদানী, আগরবাতিদানা, কাজলদানা, পঞ্চপ্রদীপদান, ডেকচি, বোল, খন্তা, সরতা, পুতুল, ঝুনঝুনি, মেডেল, বিভিন্ন শোপিছ ঘোরা, হাতি, ডলফিন, মাছ, নৌকা, ঘন্টা বিভিন্ন মূর্তি এসব অনেক কিছু। এর উপর করা হয় বিভিন্ন ধরনের ফুল পাতার নকশা, বা জ্যামিতিক কিছু কিংবা থিমভিত্তিক নকশা বানিজেদের অথবা প্রিয়জনের নাম ও লেখা হয়ে থাকে। এই জিনিস গুলা আগেকার মত নিত্য ব্যবহার্য্য না হলে ও সাজিয়ে রাখার উপকরণ হিসেবে এখনো সমাদৃত এবং কেনে অনেক সৌখিন মানুষেরা।
অথচ কাঁসার তৈজসপত্রের ব্যবহার এর রয়েছে অনেক অনেক সুফল। যেমনঃ
◑কাঁসা জীবাণুনাশক, তাই কাঁসার পাত্র পানি খেলে শরীরের জন্য তা উপকারী।
◑খাওয়ার আগে কাসার পাত্র রাখা পানি খেলে তা থাইরয়েড এর জন্য অনেক ভালো, রক্তে হেমোগ্লোবিন এর মাত্রাবেড়ে যায়।
◑মস্তিষ্ক সজাগ এবং সতর্ক করে তোলে এ ধাতু।
রোগ প্রপ্তিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
◑আয়ুর্বেদ শাত্র মনে করে যে কাঁসা ধাতু খাবার কে পরিশুদ্ধ করে, তাই কাঁসার পাত্রে খাবার খেলে তা হজমে সহায়তা করে।
যারা এ পেশার সাথে সরাসরি যুক্ত আছেন তারাও বলেন যে তাদের কোন প্রচার নেই। তারা নিজেরা প্রচার এর সাথে জড়িত না কিংবা কেউ তাদের প্রচার করেনা৷
একেবারে তৃণমূল থেকে তাদের সাথে কাজ করবে বা তাদের এ শিল্পকে আবার মেরুদন্ড দিবে এমন কোন উদ্যোগ এর ছোঁয়া তারা পায়না। ইতিহাসের এত স্বনামধন্য একটা পণ্য, ইতিহাস কে সমৃদ্ধ দানকারী এমন পণ্য , পর্যাপ্ত কর্মকার থাকার পরে ও উপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহনের অভাবে কালের গর্ভে তা হাড়িয়ে যাবে এটা আমাদের মোটেও কাম্য নয়। এক সময়ের নামী দামী এই পণ্য প্রচার এর অভাবে এবং অবহেলায় এভাবে মুখ থুবড়ে পরে যাবে এটা সত্যিই দুঃখজনক। কাঁসা পিতল তামা আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত দামী একটা সম্পদ। একে আমরা এভাবে হেলায় হাড়িয়ে ফেললে তা আমাদের জন্যই ক্ষতি।
এখন ও সুযোগ আছে আধুনিকতার ছোয়ায় আমাদের টাংগাইল এর কাঁসা পিতলের এই বিখ্যাত পণ্যটিকে সমাদৃত করার কেননা এত উপকারী , পরিবেশ বান্ধব এ পণ্য গুলোকে প্রচারের মাধ্যমে প্রসারতা দিতে পারলে অবশ্যই জনগন এইসব পণ্য কিনতে আবারো আগ্রহী হয়ে উঠবে। এখনকার মানুষজন অনেক বেশি স্বাস্থ্য সচেতন নিঃসন্দেহে এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা তাছাড়া সৌখিনতা, আবেগ স্বভাবতই আমাদের বৈশিষ্ট্য, শুধু প্রচার এর অপেক্ষা।
ই-কমার্স সেক্টর হলো আমাদের জন্য সবথেকে উপযুক্ত মাধ্যম, যাতে করে সারা দেশ সহ দেশের বাহিরে এই পণ্যগুলোকে তুলে ধরা যায়। আর এগুলো যেহেতু টেকসই এবং ভাংগার কোন সম্ভাবনা নেই তাই ডেলিভারি ও ই-কমার্স এ কোন সমস্যা হবে না। । অবশ্যই যদি ডিরেক্ট কর্মকারদের থেকে এই পণ্যগুলোকে নিয়ে কাজ করা যায়, কর্মকারদের সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে। মহাজনী ব্যবসায় তারা যেমন সামান্য লাভের মুখ দেখতে পারেনা সেটিও পরিত্রান পাবে৷ প্রয়োজন শুধু উদ্যোগ গ্রহনের, প্রয়োজন শুধু প্রচার এর তবেই আমাদের ঐতিহ্যবাহী এ পণ্যগুলো এবং এর সাথে জড়িত কর্মকার রা আবারো আশার আলো দেখবেন, উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে এবং আমাদের মূল্যবান এ শিল্প রক্ষা হবে।