রং চা কিংবা দুধ চা যায় হোক চুবিয়ে একটা বেলা না খেলে তৃপ্তির অপূর্ণতা থেকেই যায় চট্টগ্রামবাসীর। সকালে ঘুম থেকে উঠে চায়ের সঙ্গে কিংবা বিকেলের আড্ডায় বেলা বিস্কুটের বিকল্প নেই চট্টগ্রামবাসীর। বেলা বিস্কুট চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এবং উপমহাদেশের প্রথম বিস্কুট, যা এখন সারা বাংলাদেশ জুড়ে জনপ্রিয়।
বেলা বিস্কুট চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এবং উপমহাদেশের প্রথম বিস্কুট, যা সারা বাংলাদেশ জুড়ে জনপ্রিয়। এটি গোলাকার আকারে বড় এবং সাধারণ বিস্কুটের তুলনায় তুলনামূলক শক্ত হবার কারণে শুরু থেকে চায়ে ডুবিয়ে এই বিস্কুট খাবার প্রচলন ঘটে।২৫০ বছর ধরে জনপ্রিয় বেলা বিস্কুট চট্টগ্রামের মানুষসহ অনেকের বিকেলের চায়ের সঙ্গী। এটি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানি করা হয়।
নানা পদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে বিখ্যাত চট্টগ্রামের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক খাবার বেলা বিস্কুট ! চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এই বিস্কুট উপমহাদেশের প্রথম বিস্কুট।
ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত ১৭টি বেকারিতে তৈরি হতো বেলা বিস্কুট। এখনকার ক্রেতারাও বংশপরম্পরায় বেলা-বিস্কুটের গ্রাহক।যাঁরা প্রবাসে থাকেন তাঁরা ও দেশ থেকে ফিরে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিয়ে যান বেলা বিস্কুট।
দীর্ঘসময় ধরে বেলা-বিস্কুটের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। জানা যায়, বেলা-বিস্কুটের বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি মাটির তন্দুরে বানানো হতো।শুধুমাত্র তন্দুরে বানালেই নাকি বিস্কুটের আসল স্বাদ ও গুণগত মান ঠিক থাকে।
বিস্কুট বাঙালির খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় পর্তুগিজ আমলে। মোগল ও ব্রিটিশ আমলে মোগল, পর্তুগিজ ও ইংরেজদের খাদ্যাভ্যাসে ছিলো রুটি, পাউরুটি, বিস্কুটসহ বেকারি পণ্য।পর্তুগিজ আমলে অধিকাংশ পর্তুগিজ জনগণের বসবাস ছিলো বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে।তাদের খাদ্যাভ্যাসের জন্যই প্রায় ২৫০ বছর আগে চট্টগ্রামে সর্ব প্রথম বেকারি শিল্পের যাত্রা শুরু হয়।
কথাসাহিত্যিক আবুল ফজলের এবং ইতিহাসবিদ আবদুল করিম এর স্মৃতিকথায় ও উঠে এসেছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বেলা বিস্কুটের জনপ্রিয়তার কথা।
বিবেকী লেখক অধ্যাপক আবুল ফজল তাঁর আত্মজীবনী রেখাচিত্র গ্রন্থে লিখেছেন, চন্দনপুরার বেলায়েত আলী বিস্কুটওয়ালা’র নাম অনুসারে বেলা বিস্কুটের নামকরণ হয়েছে।
রেখা চিত্রে শৈশব কৈশোরকালের একটি লাইন এ রকম ‘ঘুম থেকে উঠে পান্তাভাতের বদলে খাচ্ছি গরম-গরম চা বেলা কি কুকিজ নামক বিস্কুট দিয়ে।
চট্টগ্রামের বেলা বিস্কুটের খ্যাতি এখনতো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় বেলা-বিস্কুট রপ্তানি করা হচ্ছে।
গবেষকদের ধারণা, ২০০ বছর আগে উপমহাদেশে এই বেকারিতে প্রথম তৈরি হয়েছিল বেলা বিস্কুট। বেলা-বিস্কুট তৈরির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গণি বেকারির নাম।
ব্রিটিশ আমলে থেকে এখনো চট্টগ্রামের মানুষের পছন্দের খাদ্য তালিকায় আছে ঐতিহ্যের বেলা বিস্কুট।পান্তাভাতের পরিবর্তে ধোঁয়া ওঠা চায়ে বেলা বিস্কুট ডুবিয়ে সকাল–বিকেলের নাশতা সেরে নেন এখনো চাটগাঁইয়ারা।
ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য অঞ্চলে।
ঠিক কখন গণি বেকারিতে বেলা বিস্কুট তৈরি হয় তার সঠিক তথ্য নেই। তবে মোগল আমলের শেষদিকে ও ইংরেজ আমলের শুরুতে ভারতের বর্ধমান থেকে আগত ব্যক্তিরা এই বেকারিশিল্পের সূচনা করেন চট্টগ্রামে।কারো মতে অব্দুল গণি সওদাগর পর্তুগিজদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম এই বিস্কুটের প্রচলন ঘটায়।
তবে, আবদুল গণি সওদাগরের পূর্বপুরুষ লাল খাঁ সুবেদার ও তাঁর ছেলে কানু খাঁ মিস্ত্রির হাত ধরে বেকারি পণ্য তৈরির সূচনা হয় এ অঞ্চলে—এমন তথ্যই মিলেছে গবেষকদের লেখায়।গণি বেকারি নিয়ে গবেষণা করা একাডেমির সহপরিচালক আহমদ মমতাজের মতে, মোগল ও পর্তুগিজদের খাদ্যাভ্যাসে ছিল রুটি, পাউরুটি, বিস্কুটসহ বেকারি পণ্য।
তাদের খাদ্যাভ্যাসের কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেকারিশিল্পের যাত্রা শুরু হয় প্রায় ২৫০ বছরআগে।শুরুতে রুটি তৈরি হতো বেকারিতে। এরপর ধীরে ধীরে তৈরি হয় পাউরুটি, কেক, বেলা বিস্কুট।মোগল, পর্তুগিজ বা ইংরেজদের মতো বেকারি পণ্যেও অভ্যস্ত হতে থাকে এ অঞ্চলের মানুষ।
বেকারি পণ্য তৈরির সময় তখনকার উদ্যোক্তারা বেলা বিস্কুট নামে বিশেষায়িত বিস্কুট তৈরি করেন।এ হিসেবে বেলা বিস্কুট তৈরির ইতিহাস ২৫০ বছরের কম হবে না।৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেকারিশিল্পের প্রসার ঘটে চট্টগ্রামে। গণি বেকারি থেকে ব্রিটিশ সৈনিকদের জন্য বেকারির পণ্য তৈরি হতো।
ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত ১৭টি বেকারিতে তৈরি হতো বেলা বিস্কুট। এখনকার ক্রেতারাও বংশপরম্পরায় বেলা-বিস্কুটের গ্রাহক।
আসলে তন্দুরির বেলা ছাড়া চট্টগ্রামবাসীর চায়ের আড্ডাটা জমেই না।
রাহাত সোলতানা
স্বত্বাধিকারী-অভিরুচি বুটিকস