তৃতীয় বিশ্ব থেকে প্রথম বিশ্ব—সব জায়গাতেই নারীরা বিভিন্ন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। সড়কে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন সব শ্রেণীর নারীই। পূর্ব কিংবা পশ্চিম সব জায়গাতেই নারীর প্রতি সহিংসতার একই প্যাটার্ন দেখা যায়। স্রেফ লিঙ্গ বিচারে হেয় করা, অপমান, বর্বরোচিত হামলা ও ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের শিকার হন নারীরা। যুক্তরাজ্যের অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকসের (ওএনএস) সমীক্ষা বলছে, পৃথিবীর অর্ধেক নারী অন্ধকার পথে হাঁটতে কোনো না কোনো সময় অনিরাপত্তায় ভুগেছেন। এ পরিস্থিতিতে কেউ কেউ আপনজনকে ফোন করেছেন বা হোয়াটসঅ্যাপে নিজের অবস্থান শেয়ার করেছেন। কেউ কেউ আত্মরক্ষার কথা ভেবে চাবির গোছা মুঠোয় রাখেন। চলতি বছরজুড়ে যুক্তরাজ্যে নারী নিপীড়ন আলোচ্য বিষয় হয়ে থেকেছে। প্রশ্ন উঠেছে, নারীদের নিরাপত্তা প্রদানে প্রযুক্তির ভূমিকা কতখানি? এ বিষয়ে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
চলতি বছরে যুক্তরাজ্যে দুটি নারী সহিংসতার ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। সারাহ ইভরার্ড ও শিক্ষিকা সাবিনা নেসা হত্যাকাণ্ড। হত্যা ঘটনা দুটিকে কেন্দ্র করে ওয়াকসেফ অ্যাপ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অ্যাপটি যাবতীয় অপরাধ স্থানের তথ্য সংরক্ষণ করে। এরপর ব্যবহারকারীকে সেই অনুযায়ী সবচেয়ে নিরাপদ পথটি ম্যাপে দেখিয়ে দেয়। ওয়াকসেফের প্রতিষ্ঠাতা খোদ এমা কে হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হওয়ার পর এ অ্যাপ তৈরির পরিকল্পনা করেন। আগামী বছর অ্যাপটিতে একটি স্যাট-ন্যাভ (দিক নির্ণয়) ফিচার যুক্ত হবে। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীর পরিবার-পরিজন ও বন্ধুরা তার যাত্রাপথ দেখতে পারবেন এবং একই সময় চ্যাট করতে পারবেন। চলতি বছর মার্চে অ্যাপটি বাজারে আসে। মাত্র দশ মাসেই অ্যাপটি ডাউনলোডের পরিমাণ ৫ লাখ ৬০ হাজার।
এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যের বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের একটি স্মার্টওয়াচ তৈরির গবেষণা করছে। ইপোয়ার নামে স্মার্টওয়াচটি হূদকম্পন ও শারীরিক গতিবিধি বুঝে ব্যবহারকারীর বিপদের ইঙ্গিত পাবে। এর মাধ্যমে ইপোয়ার স্বয়ংক্রিয়ভাবে সতর্কতা জারি করবে। ইপোয়ারের সহপ্রতিষ্ঠাতা ই-জে রুড অন্ধকারাচ্ছন্ন এক পার্কে হাঁটতে গিয়ে অনিরাপত্তা বোধ করছিলেন। সেই থেকে অ্যাপ তৈরির পরিকল্পনা করেন তিনি। রুড বলেন, স্মার্টওয়াচ ব্যবহারকারীর হার্ট অ্যাটাক শনাক্ত করতে পারে। এ থেকেই নারীদের নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব স্মার্টওয়াচ আবিষ্কারের ধারণা করেন তিনি।
নারী সহিংসতা রোধে ওয়াকসেফের মতো আরেকটি অ্যাপ হলো বিসেফ। ব্যবহারকারীর পরিজনদের সতর্ক করা ছাড়াও অপরাধের প্রমাণও সংগ্রহ করে বিসেফ। অ্যাপটিতে একটি ইমার্জেন্সি অ্যালার্ম ফিচার সংযুক্ত থাকে। ফিচারটি ব্যবহারকারীর কণ্ঠস্বর শুনে চালু হয়। বিপদে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটি ব্যবহারকারীর ফোন কন্ট্যাক্টদের কাছে অডিও রেকর্ড ও লাইভ সম্প্রচারের কাজ করে। বিসেফের প্রতিষ্ঠাতা রিচ লারসেন বলেন, এ রেকর্ডগুলো পরবর্তী সময়ে আদালতে সাক্ষ্য প্রমাণস্বরূপ ব্যবহার করা যাবে। রিচার্ড লারসেনের মেয়ে চার্লেনের ধর্ষণের প্রমাণ করতে কাঠখড় পোড়াতে হয়। রিচার্ড বলেন, এ ঘটনা থেকেই তৈরি হয় বিসেফ।
২০২০ সালের ক্রাউন প্রসিকিউশনের তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাজ্যের মোট ৫৮ হাজার ৮৪৫টি ধর্ষণ ঘটনার মাত্র ২ হাজার ১০২টির মামলা হয়েছে। ১ হাজার ৪৩৯টি মামলার শাস্তি হয়েছে।
চলতি বছর জুলাইয়ে রাতে নারীদের নিরাপত্তা দিতে যুক্তরাজ্যের হোম অফিস ৫০ লাখ পাউন্ড বরাদ্দ করে। এর একাংশ নারী সহিংসতা রোধ প্রকল্পে প্রযুক্তিতে বরাদ্দ দেয়া হয়। ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ার কর্তৃপক্ষ একটি অনলাইন লিংক তৈরির কাজ করছে। গণপরিবহনে নারীদের নিশ্চয়তা প্রদানে কাজ করবে এ প্রযুক্তি।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারী নিপীড়ন প্রতিরোধে প্রযুক্তির ব্যবহার থাকলেও প্রতিকারের জন্য চাই মূল্যবোধ ও শুভবোধের উদয়। উইমেন’স এইডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফারাহ নাজির বলেন, শুধু প্রযুক্তির মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। স্মার্টওয়াচ বা অ্যাপ নারীদের নিরাপদ বোধ করাতে পারে বটে, তবে এ ব্যবস্থাগুলো মূল রোগের সাময়িক উপশম। তিনি বলেন, অনিরাপত্তায় ভোগার কারণ আলোর স্বল্পতা বা অ্যাপের অভাব নয়, বরং সমাজে নারীবিদ্বেষী মানসিকতার চর্চা।