আধুনিক শহুরে জীবনযাত্রায় কোনো বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া ক্রমশঃ কঠিন হয়ে পড়ছে। একটু সময় পেলেই চোখ চলে যায় স্মার্টফোনের দিকে। বিজ্ঞানীরা এই আচরণ বিশ্লেষণ করে ‘স্বাভাবিক’ জীবনযাত্রার পথ বাতলে দিচ্ছেন।
আধুনিক যুগে মানুষের জীবনযাত্রা অত্যন্ত ব্যস্ত হতে পারে। এক সমীক্ষা অনুযায়ী জার্মানির অর্ধেক মানুষ নিজেদের সবসময় ব্যস্ত মনে করেন। আমাদের মতো অনেকে যখন বাসের অপেক্ষায় হাতে একটু সময় পাই, তখন স্মার্টফোন সেই সময় গ্রাস করে ফেলে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী আমরা দিনে গড়ে ৮৮ বার ফোনের দিকে তাকাই। তথ্য সংগ্রহ করি, বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট করি, সংবাদ পড়ি। জার্মানির মানুষ দিনে গড়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা অনলাইন থাকেন। তরুণ প্রজন্ম এমনকি দিনে সাত ঘণ্টা ফোন ও অন্যান্য মোবাইল ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। স্নায়ুবিজ্ঞানী হেনিং বেক অবশ্য বাসের জন্য অপেক্ষার সময় কোনোমতেই ফোন বার করেন না। এমন সিদ্ধান্তের পেছনে কারণও রয়েছে।
বেশিরভাগ মানুষ কেন সারাক্ষণ নিজেদের ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকেন? হেনিং বেক মনে করেন, ‘‘যা কিছু নতুন, তার থেকে বেশি আকর্ষণীয় কিছু হতে পারে না। জন্ম থেকেই আমাদের মধ্যে সহজাত কৌতূহল রয়েছে। বিস্ময়ের সব কারণ আমরা ভালোবাসি। আধুনিক ফোন সত্যি সেই চাহিদা মেটায়।”
হেনিং বেক ফ্রাংকফুর্ট শহরে এক থিংক ট্যাংক গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। এই গোষ্ঠী ভবিষ্যৎ প্রবণতা সম্পর্কে গবেষণা চালিয়ে বিভিন্ন কোম্পানিকে পরামর্শ দেয়। সাংস্কৃতিক নৃতত্ববিদ হিসেবে লেনা পাপাসাবাস আমাদের জীবনে ডিজিটাল মিডিয়ার প্রভাব সম্পর্কে এক ওয়ার্কশপ আয়োজন করেছেন। লেনা বলেন, ‘‘ব্যবহারকারী সাড়া পাবার আশায় এমনটা করেন বলে আমার বিশ্বাস। আপনি জানতে চান, কেউ কি আমাকে কিছু লিখেছে, আমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে? আমি কি নতুন লাইক পেয়েছি? সবাই সাড়া পেতে চায়। এমন সাড়া অন্য কেউ, চারিপাশের জগত, এমনকি নিজের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক নিশ্চিত করে। কেউ কোথাও আমাকে দেখছে, শুনছে এবং তার ফলে আমি নিজেকে ঠিকমতো জীবিত বলে মনে করছি।”
ফোন হাতে নেবার পেছনে আরও কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে। একটি কারণ হলো, আমরা একঘেয়েমি পছন্দ করি না। অ্যামেরিকায় এক গবেষণা এই সত্য তুলে ধরেছে। বিজ্ঞানীরা কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীকে একটি ঘরে ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেখানে তাদের এমন যন্ত্রের সামনে বসানো হয়েছিল, যা মৃদু বৈদ্যুতিক শক দেয়। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরুষদের দুই-তৃতীয়াংশ ও নারীদের এক-চতুর্থাংশ যন্ত্রের বোতাম টিপেছিলেন। লেনা পাপাসাবাস এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘অনেক মানুষ সর্বত্র তাঁদের মোবাইল ফোন নিয়ে যান, এমনকি অন্য ঘরে গেলেও সেটি সঙ্গে থাকে। এমনকি ফোন সঙ্গে না থাকলেও তার ভাইব্রেশন অথবা রিং টোন কল্পনা করেন। ফলে তাদের কিছুটা বাতিকগ্রস্ত বলা চলে।”
অথচ কিছু না করাই অনেক বেশি ফলদায়ক হতে পারে। কারণ জীবনযাত্রার গতি কমিয়ে আনলেই মস্তিষ্ক সৃজনশীল হবার সুযোগ পায়। সে সময়েই সেরা আইডিয়া মাথায় আসে।
দুই বিশেষজ্ঞই মনে করেন, যে মাইন্ডফুলনেস বা মনোযোগ ডিজিটাল যুগে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। হেনিং বেক বলেন, ‘‘খাবার খেলে তা হজম করতে শরীরের কিছু সময় লাগে। লাগাতার খেয়ে গেলে আমার শরীর ফেটে যেত। তথ্যের ক্ষেত্রেও বিষয়টি এক। মস্তিষ্কেরও ভেবে দেখার, চিন্তা করার সময় লাগে, অগ্রাধিকার স্থির করতে হয়।
সে কারণেই হেনিং বেক বাসের জন্য অপেক্ষা করার সময় ফোন পকেটেই রাখেন। এভাবে তিনি তাজা অভিজ্ঞতাগুলি ‘হজম’ করার সুযোগ পান।- ডিডাব্লিউ থেকে