পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ই- কমার্স কোম্পানী অ্যামাজন চীন থেকে তাদের ই-কমার্স ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে চলতি বছরের জুলাই মাসে। অ্যামাজন বলছে যে এর চাইনীজ ওয়েবসাইট বা মার্কেটপ্লেস থেকে কোনরকম পন্য বিক্রয় বা লেনদেন করবে না। তবে প্রতিষ্ঠানটি এও বলছে, চায়নার কাস্টমাররা অ্যামাজনের গ্লোবাল সেলিং প্লাটফর্ম থেকে মানে চীনের বাইরে বিভিন্ন দেশের অ্যামাজনের ওয়েবসাইট থেকে যে কোন পন্যের অর্ডার করতে পারবে বা কিনতে পারবে। এটি স্বাভাবিকভাবেই অ্যামাজন ও ই-কমার্স দুনিয়ার জন্য এটি অনেকটা ভূমিকম্পের মত মনে হলেও যারা এই ইন্ডাস্ট্রির খবর দীর্ঘ দিন ধরে রাখেন তাদের জন্য খুব অবাক করা কিছু মনে হবার কথা নয়।
চীনে অ্যামাজনের পতনের কারন
আমেরিকার সবচেয়ে বড় রিটেইলার কোম্পানী অ্যামাজন ২০০৪ সালে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চায়নায় প্রবেশ করে। কিন্তু শুরু থেকেই চাইনিজ মার্কেটে তাদের ব্যবসা করা তেমন সহজ ছিলনা কারন অ্যামাজনের চায়নার সবচেয়ে বড় দুই প্রতিযোগী স্থানীয় কোম্পানী আলীবাবা এবং জেডি ডট কম শুরু থেকেই খুব শক্ত অবস্থান রয়েছে। অ্যামাজন শুরু থেকেই চাইনিজ ক্রেতাদের কে তেমন আকর্ষন করতে পারেনি কারন শপিং থেকে শুরু করে পেমেন্ট সার্ভিজ, পন্য ডেলিভারী এবং অনান্য সু্যোগ সুবিধার জন্য চাইনিজ ক্রেতারা তাদের দেশীয় দুই কোম্পানী আলীবাবা এবং জেডি ডট কমকে বেশী প্রাধান্য দিয়েছে। চায়নার স্থানীয় ক্রেতাদের কি ধরনের পন্য পছন্দ বা তারা কোন ধরনের পন্য চাচ্ছে তা ঠিকমত বুঝে উঠতে না পারার কারনে অ্যামাজন তাদের ক্রেতা ধরে রাখতে পারেনি।
কনজিউমাস রির্সার্চ ফার্ম আইরিসার্চ গ্লোবালের তথ্য মতে, ২০১৮ সালে চাইনীজ ইকমার্স মার্কেটের ৮২% নিয়ন্ত্রন করেছে আলিবাবার টিমল এবং জেডি ডট কম। চাইনীজ রিসার্চ ফার্মের তথ্য মতে এই বছর চায়নার কনজিউমার অনলাইনে বিক্রি আগের বছরের তুলনায় ৩১% বেড়ে ২০১৮ সালে ৭৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাড়িয়েছে। তারা আরো বলছে, ২০১৮ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে চায়নার ইকমার্স ব্যবসায়ের ৬১. ৫% মার্কেট শেয়ার আলীবাবার টিমল, জেডি ডট কম ২৪.২% এবং অ্যামাজন 0.৬% এবং অনান্য কোম্পানী দখলে ছিল ৬.৭% । অর্থাৎ চাইনিজ ই-কমার্স মার্কেটে ১% এর কম মার্কেট শেয়ার অ্যামাজনের দখলে ছিল। সেজন্য এখন অ্যামাজন চাইনিজ ই-কমার্স মার্কেটে থেকে সরে এসে ইণ্ডিয়া এবং জাপানের ই-কমার্স মার্কেট ভালভাবে নজর দেবার চিন্তা করছে।
অ্যামাজন চাইনিজ মার্কেটে ব্যর্থ হওয়ার কয়েকটি কারনের মধ্যে অন্যতম হল স্থানীয় ক্রেতাদের কোন ধরনের পন্য পছন্দ তা বুঝতে না পারার কারনে লোকাল কোম্পানী গুলো (আলী বাবা এবং জেডি ডট কম) সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে। আলীবাবা এবং জেডিডট কম চায়নার কোন অঞ্চলের মানুষ কোন ধরনের পন্য পছন্দ করে বা চায়নার প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্রেতারা কত সহজেই পন্য ক্রয় এবং পেমেণ্ট করতে পারবে সে দিকে সবচেয়ে বেশী নজর দিয়েছে। তাছাড়া এই দুই লোকাল জায়াণ্ট কোম্পানীর ওয়েবসাইটে চায়নার বিভিন্ন উৎসব বা অনুষ্ঠানে নানা রকম পন্যের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনদেওয়া হয় এবং সাথে সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পন্যের উপর ছাড় সহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে চাইনিজ ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছে।
আলিবাবা বনাম অ্যামাজন
আলীবাবা শুরু থেকেই ছোট এবং মাঝারী ব্যবসায়ীদের জন্য মার্কেটপ্লেস তৈরি করে দিয়েছে যেখানে ছোট ছোট বা মাঝারী মানের ব্যবসায়িরা খুব সহজেই অনেক বেশী পরিমানে পন্য বিক্রয় করতে পারছে। সেই তুলনায় অ্যামাজনের চাইনিজ ওয়েবসাইটি অনেকটা আমেরিকার মত যার কারনে স্থানীয় ক্রেতাদের কাছে বুঝতে বা অভ্যস্ত হতে কঠিন হওয়ার কারনে তারা পন্য ক্রয়ে তেমনটা আগ্রহ দেখায় নি এবং অ্যামাজনের মার্কেটপ্লেসে চীনের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য তেমন সু্যোগ সুবিধা না থাকার কারনে অ্যামাজন চায়নিজ ই-কমার্স মার্কেটে তেমন ভাল করতে পারেনি।
চাইনিজ মার্কেটে আলীবাবার শক্তি
১৯৯৯ সালে চায়নার সবচেয়ে বড় ই-কমার্স কোম্পানী আলীবাবা প্রতিষ্ঠা করেন জ্যাক মা। বর্তমানে চায়নায় আলীবাবার মাসিক এক্টিভ ইউজারের সংখ্যা ৫০০ মিলিয়নের বেশী। শুরু থেকেই আলীবাবার মুল ফোকাস ছিল কিভাবে অনলাইনের মাধ্যমে ছোট এবং মাঝারি ব্যবসায়ীদের বিক্রয় বাড়ানো যায় সেই সাথে সাথে চায়নার মানুষদেরকে সল্প মুল্যে তাদের পছন্দসই পন্য দেওয়া যায়। এইভাবেই তারা একের পর পর এক বিজনেস টু বিজনেস (B2B) এবংকনজিউমার টু কনজিউমার(C2C) রিটেইল প্লাটফর্ম গড়ে তোলে যেখানে মার্চেন্ট এবং ক্রেতারা খুব সহজেই পন্য দ্রব্য ক্রয় -বিক্রয় করতে পারে । যার ফলে চাইনিজ ই-কমার্স মার্কেট আলীবাবা অ্যামাজনের থেকে অনেক এগিয়ে যায়।
চীনের ই-কমার্স মার্কেটের বৈশিষ্ট্যঃ সারা বিশ্বে চীন হল ই-কমার্সের সবচেয়ে বড় বাজার। বর্তমানে সারা বিশ্বের ই-কমার্সের মার্কেটের ৪২% চীনের দখলে অপরদিকে আমেরিকার রয়েছে মাত্র ২৪%। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা গত কয়েক বছরে অবিশ্বাস্য গতিতে বেড়েছে চিনে। তাছাড়া মোবাইল পেমেন্টের বেলাতেও আমেরিকার থেকে অনেক অনেক এগিয়ে গেছে দেশটি। ই-কমার্স মানেই ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি গুলোর বিনিয়োগ এবং চীন এদিকেও দ্রুত আমেরিকাকে ধরে ফেলছে।
চায়নার গ্রামাঞ্চলে এখনো অনেকে ই-কমার্স সেবার আওতার বাইরে বা তেমন ডেলিভারি হয় না সেখানে। তাই আগামি কয়েক বছর ধরে চীনের ই-কমার্সের বাজার বাড়তেই থাকবে।
অ্যামাজনের আরো চ্যালেঞ্জঃ চীনে গিয়ে ব্যবসা করা যে কোন বিদেশি কোম্পানির জন্য চ্যালেঞ্জ। চীনের সরকারি নীতি সব সময় দেশি কোম্পানি গুলোর পক্ষে থাকে। গুগল পর্যন্ত সেখানে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু অ্যামাজনের জন্য ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের বানিজ্য নীতি মাথা ব্যথা হয়ে দাড়িয়েছে। এছাড়া অ্যামাজনের মালিক জেফ বেজসের তার স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ এসব মিলে অ্যামাজনের জন্য কিছুটা উদ্বেগের সময় যাচ্ছে।
চীনের ক্রেতারা অ্যামাজনের আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইট গুলো থেকে পন্য কিনতে পারবেন তবে এসব ক্ষেত্রেই এখন আলিবাবা আর জেডি চাইবে অ্যামাজনের মার্কেটে ভাগ বসাতে। এশিয়াতে এখন অ্যামাজন স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের বাজারের দিকে ঝুকবে বেশি করে। গত ৫ বছরে ভারতে অ্যামাজন ৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং সেখানে ওয়ালমার্ট মালিকানাধীন ফ্লিপকার্টের সাথে প্রতিযোগিতা করছে। অ্যামাজন আর ফ্লিপকার্ট মিলে ভারতের ই-কমার্স বাজারের ৮০% দখল করে আছে।
চীন থেকে শিক্ষা নিয়ে তা ভারতে কিভাবে অ্যামাজন কাজে লাগায় তাই দেখার বিষয়। ওয়ালমার্ট প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করছে ফ্লিপকার্টে যাতে করে ভারতের বাজারে তারা অ্যামাজনের থেকে অনেক এগিয়ে থাকে। অ্যামাজনের উচিৎ ভারতের স্থানীয় ক্রেতাদের রুচি, অভ্যাস, পছন্দ এসবের দিকে নজর দেয়া। না হলে এখানেও অ্যামাজন বিপদে পরতে পারে।
অ্যামাজনের চীনে ব্যর্থতা থেকে আমরা এটুকু বুঝতে পারছি যে ই-কমার্সের ভবিষ্যৎ আমেরিকাতে নয়- চীনে। আর ভারতের উচিৎ চীনের উদাহরণ থেকে শেখা, বাংলাদেশেরও।
তথ্যসূত্র: Deutsche Welle, Techcrunch, NY Post, Brinkwire ও CGTN
লেখক: রাজিব আহমেদ, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশান অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এবং
জান্নাত কাদের চৌধুরী, হেড অব কন্টেন্ট, সার্চ ইংলিশ লিমিটেড