মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছেন না হুয়াওয়ের প্রতিষ্ঠাতা রেন ঝেংফেই। উল্টো ট্রাম্প প্রশাসন হুয়াওয়ের ‘সক্ষমতাকে খাটো করে দেখেছে’ বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। রেন ঝেংফেই জোর দিয়ে বলেন, অদূরভবিষ্যতে ফাইভজি প্রযুক্তিতে হুয়াওয়ের ধারে কাছেও কেউ থাকবে না।
সম্প্রতি চীনা প্রযুক্তি জায়ান্ট হুয়াওয়েকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এর ফলে এখন থেকে মার্কিন কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়তে চাইলে মার্কিন প্রশাসনের অনুমতি নিতে হবে। ট্রাম্প প্রশাসনের এ সিদ্ধান্তকে চীনা কোম্পানিটিকে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে নিষিদ্ধ করার প্রচেষ্টা বলেই মনে করা হচ্ছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোতেও ব্যবসার ক্ষেত্রে নানা বাধার মুখে পড়তে শুরু করেছে হুয়াওয়ে। এর ফলে হুয়াওয়ের টেলিকম সরঞ্জাম ব্যবসা, বিশেষ করে ফাইভজি অবকাঠামো বাণিজ্যে বড় ধরনের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। গুগল এখন থেকে ওপেন সোর্স লাইসেন্সের বাইরে হুয়াওয়ের কোনো ডিভাইসে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম সম্পর্কিত হালনাগাদ দেবে না বলে জানিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে ফাইভজি প্রযুক্তিতে দ্রুত নিজেদের সেবা বাড়াচ্ছে হুয়াওয়ে, তবে এখনো অনেক যন্ত্রাংশের জন্য বিদেশী প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয়। প্রতি বছর ৬ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের যন্ত্রাংশ কেনে হুয়াওয়ে। এর মধ্যে ১ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের যন্ত্রাংশ কেনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
হুয়াওয়ের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপের কারণেই নিজের আড়াল থেকে বের হয়ে আসতে হচ্ছে রেন ঝেংফেইকে।
রেন এর আগে চীনা সেনাবাহিনীতে ছিলেন। হুয়াওয়ের ‘অস্বাভাবিক সংস্কৃতি’ অনেকে দেশে চীনা গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির সম্পর্কের বিষয়ে সন্দেহ জাগায়।
এ ছাড়া হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ‘তীব্র প্রচার’ কার্যক্রম লক্ষণীয়। মিত্র দেশগুলোকে ফাইভজি নেটওয়ার্কে হুয়াওয়েকে না রাখতে চাপ দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সরকারি সংস্থাগুলোয় হুয়াওয়ের ডিভাইস কেনা নিষিদ্ধ। রেন বলেছেন, আইন ভঙ্গ করে এমন কোনো কিছু আমরা করিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত পদক্ষেপের কারণে সীমিত প্রভাব পড়বে উল্লেখ করে রেন বলেছেন, হুয়াওয়ের প্রবৃদ্ধি হয়তো কমবে, কিন্তু তা সামান্য।
সেনাবাহিনীর সাবেক প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করার পর ১৯৮৭ সালে মাত্র পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার পকেটে নিয়ে হুয়াওয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রেন। হুয়াওয়ের দাবি, বিশ্বের ১৭০টি দেশে তাদের কার্যক্রম রয়েছে এবং কর্মীসংখ্যা এক লাখ ৯০ হাজার। ২০১৮ সালে তাদের রাজস্ব ছিল ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
রেন বলেন, কোনো রকম চাপের কাছে তারা মাথা নোয়াচ্ছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ বা তাদের নজরদারির সুযোগ দিতে ব্যবস্থাপনায় কোনো পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। এর আগে আরেক মার্কিন প্রতিষ্ঠান জেডটিই মার্কিন চাপে নতি স্বীকার করেছিল। তাদের পথে হুয়াওয়ে হাঁটবে না।
গুগল ছাড়লে বাজার হারাবে
গুগলের বিকল্প আনার একাধিক চেষ্টা এরই মধ্যে ব্যর্থ হয়েছে। মাইক্রোসফট, ব্ল্যাকবেরি, নকিয়া নিজেদের ইকোসিস্টেম ডেভেলপের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু অ্যান্ড্রয়েডের অপ্রতিরোধ্য গতির কাছে সবাই হার মেনেছে। এ কারণে কোনো বিকল্প ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক বাজার অংশীদারিত্ব ধরে রাখার ক্ষেত্রে হুয়াওয়েকে রক্ষা করতে পারবে বলে মনে করছেন না বিশ্লেষকরা। যদিও চীনা প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম তৈরির ঘোষণা দিয়েছে।
ওপেন সোর্স হওয়ার কারণে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম পেতে হুয়াওয়েকে কোনো বাধার মুখে পড়তে হবে না। কিন্তু মূল সমস্যাটা গুগলের স্বত্ব-সংবলিত সেবা না পাওয়া। এ কারণেই শুধু অপারেটিং সিস্টেম হুয়াওয়ের তেমন কাজে আসবে না। হুয়াওয়ে বর্তমানে মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশই সরবরাহ করে চীনের বাইরের বাজারে। এখন ক্রেতাদের মধ্যে বিদ্যমান প্রবণতা অনুযায়ী ডিভাইস কেনার ক্ষেত্রে সবার আগে বিবেচনায় থাকবে অ্যান্ড্রয়েড ইকোসিস্টেম বা গুগলের সার্ভিস। ডিভাইসে এটি না থাকা মানে ক্রেতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপেই পিছিয়ে পড়বে হুয়াওয়ে।
হুয়াওয়ের পাশে চীনের দেশপ্রেমিক ভোক্তারা
হুয়াওয়েকে ব্যাপক সমর্থন দিতে একাত্ম হয়েছে চীনা সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে বলছেন, তারা অ্যাপলের পণ্য বয়কট করে এখন থেকে হুয়াওয়ের পণ্য কিনবেন। হুয়াওয়ের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এভাবেই মার্কিন পণ্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছেন চীনের দেশপ্রেমিক ভোক্তারা।
চীনের সঙ্গে অব্যাহত বাণিজ্যযুদ্ধের অংশ হিসেবে হুয়াওয়েকে নানাভাবে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। হুয়াওয়ের যেকোনো যন্ত্রাংশ ও স্মার্টফোন বিক্রি করতে চাইলে সেই মার্কিন প্রতিষ্ঠানকে সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। এ পরিস্থিতিতে চীনের সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা হুয়াওয়ের পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করেছেন। চীনা মাইক্রো ব্লগিং সাইট উইবোতে একটি হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে জানানো হয়েছে, হুয়াওয়েকে চিপের ক্ষেত্রে মার্কিন সাপ্লাই চেইনের ওপর নির্ভর করার কোনো প্রয়োজন নেই। হ্যাশট্যাগটি প্রায় পাঁচ কোটিবার দেখা হয়েছে। উইবোতে অনেকেই অ্যাপলের পরিবর্তে হুয়াওয়ের ডিভাইস কেনার ঘোষণা দিয়েছেন।