দেশে অবৈধ মোবাইল ফোনের সয়লাব ঠেকাতে একের পর এক পরিকল্পনা নেয়া হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। তিন তিনবার উদ্যোগ নিয়েও ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (এনইআইআর) চালু করতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। প্রশ্ন উঠেছে—বারবার এই উদ্যোগ থমকে যায় কেন? কে বা কারা নাড়ায় সেই ‘অদৃশ্য কলকাঠি’?
সরকার যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা ও রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে, তখনই বারবার গোঁজামিল লেগে যাচ্ছে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে। চলতি বছরের শুরুতেই সব প্রস্তুতি শেষ হলেও, হঠাৎ করেই পেছালো এনইআইআর চালুর সিদ্ধান্ত। এতে আবারও দীর্ঘায়িত হলো প্রকল্পটি, বাড়লো খরচ—আর রাজস্ব হারানোর ক্ষতি তো আছেই।
জানা গেছে, বর্তমানে দেশের মোবাইল বাজারের আকার প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। এই বাজারের প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ দখল করে রেখেছে অবৈধ বা চোরাই মোবাইল ফোন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে সচল থাকা প্রায় ২০ লাখ আইফোনের মধ্যে বৈধ মাত্র ২০০টি! স্যামসাংয়ের ক্ষেত্রেও প্রায় ১.৫ কোটির বেশি হ্যান্ডসেট অবৈধভাবে সচল। অথচ এসব ফোন বিটিআরসির আইএমইআই ডেটাবেইজে নেই।
এনইআইআর বাস্তবায়নে বারবার পেছানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মোবাইল হ্যান্ডসেট খাতের উদ্যোক্তারা। মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এমআইওবি)-এর সভাপতি জাকারিয়া শাহিদ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘বারবার কেন উদ্যোগ নেওয়া হয়েও পিছিয়ে আসে বিটিআরসি? কে বা কারা বাধা দিচ্ছে, সেটা জানাটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘বাজারে উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের প্রায় ৯৯ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হলেও চোরাই পণ্যে বাজার ভরে গেছে। বৈধ আমদানিতে যেখানে ৫৮ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক, সেখানে অবৈধ ফোনে কোনো কর নেই—ফলে বিনিয়োগকারীরা মার খাচ্ছেন, সরকার হারাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু রাজস্ব নয়—নিরাপত্তার দিক থেকেও এই অবৈধ ফোনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলো সিম রেজিস্ট্রেশনের বাইরে থাকায় অপরাধীদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এদিকে বিটিআরসি জানায়, এনইআইআর সচল রাখতেই তাদের প্রতি মাসে খরচ করতে হচ্ছে ৩.৫৯ লাখ টাকা, নতুন করে এএমসি করতে বছরে ব্যয় হবে ৩.৫ কোটি টাকা। অথচ কার্যকর ব্যবহার না থাকায় এই ব্যয় অর্থহীন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. এমদাদ উল বারী বলেন, ‘সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো স্মার্টফোনকে সবার নাগালে আনা। আমরা এনবিআরে হ্যান্ডসেটের ওপর কর কমানোর সুপারিশ করেছি। একইসঙ্গে এনইআইআর বাস্তবায়নের কাজও চলছে।’
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, ‘এনইআইআর কার্যকর করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যোগ্য ও অভিজ্ঞ দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দায়িত্ব দেওয়া হবে।’
সব মিলিয়ে এখন সবার প্রশ্ন—এতদিন ধরে কেন এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলো না? কেন বিটিআরসি নিজেই নিজেকে আটকে রাখে? জনগণের প্রত্যাশা, এবারের উদ্যোগ যেন আর থেমে না যায়—এনইআইআর যেন হয় প্রযুক্তি ও স্বচ্ছতার নতুন দিগন্ত।
বাংলাদেশে ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ে তোলার অন্যতম প্রধান সহায়ক হচ্ছে মোবাইল হ্যান্ডসেট। অথচ, এই খাতেই যখন বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম ও অবৈধ প্রবাহ চলতে থাকে, তখন সেটি শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়, রাষ্ট্রের রাজস্ব, বিনিয়োগ ও নিরাপত্তা—তিনটি স্তম্ভকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে। এনইআইআরের মতো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বছরের পর বছর অদৃশ্য কোনো প্রভাবের কারণে থমকে থাকায় সাধারণ মানুষ, বিনিয়োগকারী এবং দেশপ্রেমিক নাগরিকদের মনে প্রশ্ন জাগে—এই কলকাঠি নাড়ায় কারা? রাষ্ট্রের স্বার্থের বিপরীতে এতো বড় পরিসরে দুর্বলতা বা ইচ্ছাকৃত বিলম্ব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এখনই সময়, কঠোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক উদ্যোগের মাধ্যমে এই প্রকল্পকে পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করার। এতে শুধু অবৈধ হ্যান্ডসেট বন্ধ হবে না, বরং সরকারের হাজার কোটি টাকার রাজস্ব রক্ষা পাবে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে, কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে এবং অপরাধ দমন সহজ হবে। এনইআইআর যেন আর বিলম্বের শিকার না হয়, বরং একটি কার্যকর ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠে—এই প্রত্যাশা এখন দেশের প্রতিটি নাগরিকের।