মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’–এর অনিয়ম ধরতে ফরেনসিক নিরীক্ষা না করার নির্দেশনা চেয়ে দায়ের করা রিট খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। রিট খারিজের ফলে নগদের দুর্নীতি তদন্তে ফরেনসিক অডিটে আর কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।
একজন শেয়ারহোল্ডারের পক্ষে করা এ সংক্রান্ত রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বুধবার (২১ মে) হাইকোর্টের বিচারপতি ফাতেমা নজিব ও বিচারপতি শিকদার মাহমুদুর রাজী’র সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন ব্যারিস্টার নওশাদ জমির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনিক আর হক, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) ব্যারিস্টার ওসমান চৌধুরী, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল (এএজি) ইমরুল কায়েছ রানা, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল তামান্না সুলতানা ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ইমামুর মুশফিকুর।
ফরেনসিক নিরীক্ষা হলো, কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের বিস্তারিত খতিয়ে দেখা, যার মাধ্যমে যেকোনো জালিয়াতি ও অনিয়ম খুঁজে বের করা সম্ভব। সাধারণত এ নিরীক্ষায় কোনো অনিয়ম ধরা পড়লে তা আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের আর্থিক খাতে ফরেনসিক নিরীক্ষা তেমন দেখা যায় না।
নগদের মালিকানার সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীরা যুক্ত। ফলে বিদায়ী সরকারের সময়ে কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থাই এটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। নগদের মালিকানার সঙ্গে বিভিন্ন সময় যুক্ত ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকনের স্ত্রী রেজওয়ানা নূর, সাবেক সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক ও রাজী মোহাম্মদ ফখরুল।
এদিকে নগদের অনিয়ম ধরতে ফরেনসিক নিরীক্ষা সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২১ আগস্ট ‘নগদ’কে পরিচালনা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন প্রশাসক নিয়োগ করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক মুহম্মদ বদিউজ্জামান দিদারকে। পাশাপাশি ছয়জন কর্মকর্তাকে ‘সহায়ক কর্মকর্তা’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২৩ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক ও ডাক বিভাগের কর্মকর্তারা নগদের কার্যালয়ে গিয়ে পুরো প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন।
নগদ এখন আগের মতোই স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠানটিতে আগে নিয়োগ পাওয়া কর্মীরাই দায়িত্ব পালন করছেন। শুধু সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তানভীর আহমেদ, নির্বাহী পরিচালক নিয়াজ মোর্শেদ ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মারুফুল ইসলাম দায়িত্বে নেই। তারা প্রত্যেকেই নগদের মালিকানার সঙ্গেও যুক্ত।
এদিকে নানা অনিয়ম-বিচ্যুতি ধরা পড়ায় পূর্ণাঙ্গ তথ্য ও সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে নগদের সার্বিক কার্যক্রমের ওপর ফরেনসিক নিরীক্ষা করার জন্য ডাক অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসক। চিঠিতে ডাক বিভাগের ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’–এর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নিয়মিত অডিট তথা নিরীক্ষা এবং বিগত অর্থবছরগুলোর সব কাজের ফরেনসিক নিরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, নগদের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আর্থিকসহ সব কাজের নিয়মিত নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। এছাড়া নগদের বিগত অর্থবছরগুলোর আর্থিকসহ সব কাজের গুণাগুণ বিচারের জন্য ফরেনসিক নিরীক্ষা করা প্রয়োজন মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। তাই নগদের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নিয়মিত নিরীক্ষা এবং বিগত অর্থবছরগুলোর আর্থিকসহ সব কাজের ফরেনসিক নিরীক্ষার প্রয়োজনে উদ্যোগ নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে চিঠিতে।
জানা গেছে, চিঠি দেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ডাক অধিদপ্তরের আলোচনা হয়েছে। এতে ফরেনসিক নিরীক্ষার বিষয়ে উভয়পক্ষ একমত হয়। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, নগদের কার্যক্রমের ওপর ফরেনসিক নিরীক্ষা পরিচালনার ব্যাপারে আলোচনা চলছে। সবাই একমত পোষণ করেছেন। নিরীক্ষা হলেই প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসবে।
অপরদিকে, নগদে বাংলাদেশ ব্যাংকের নবনিযুক্ত প্রশাসককে হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে রাজধানীর বনানী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন প্রশাসক মুহম্মদ বদিউজ্জামান দিদার। জিডিতে তিনি প্রতিষ্ঠানটির সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তানভীর আহমেদ মিশুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন।
জিডিতে একটি ফোন নম্বরের উল্লেখ করে বদিউজ্জামান দিদার জানান, ৪ সেপ্টেম্বর তার মুঠোফোনে নগদের সাবেক সিইও তানভীর মিশুক হোয়াসটঅ্যাপের মাধ্যমে খুদে বার্তা পাঠিয়েছেন। তিনি ওই খুদে বার্তার বক্তব্যে ‘এক ধরনের হুমকি বোধ’ করছেন। সেজন্য তিনি জিডি করেছেন।
নগদের কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটানোর অভিযোগ উঠেছে তানভীর আহমেদ মিশুকের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। নগদে যখন প্রশাসক বসানোর সিদ্ধান্ত হয়, তখন তিনি বিদেশে অবস্থান করছিলেন এবং এখনো দেশে ফেরেননি বলে জানা গেছে।