কসময় তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করলেও ক্রমশ বাইক-রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ব্যবহারের প্রবণতা কমতে থাকায় কোম্পানিগুলো মুখথুবড়ে পড়ছে; বাধ্য হচ্ছে তাদের পরিষেবা বন্ধ করতে। এমনকি নিবন্ধিত ১৫টি কোম্পানির মধ্যে ১৩টির বার্ষিক লাইসেন্স নবায়ন হয়নি।
এরমধ্যে তিনটি রাইড শেয়ারিং কোম্পানি লাইসেন্স নবায়নের জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে আবেদন জানিয়েছে। আর বাকি ১০ প্রতিষ্ঠানের কিছু ইতিমধ্যেই তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে।
যাত্রীরা অ্যাপ ব্যবহারে আগ্রহ হারাচ্ছেন, অফ-অ্যাপ রাইডই বেছে নিচ্ছেন অধিকাংশ; স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশন নির্ভর যুগের বহু আগে থেকেই যে চর্চা দেশে প্রচলিত ছিল।
পাঠাও এবং উবার- এই দুটো প্রতিষ্ঠানই কেবল সময়মতো পারমিট নবায়ন করতে পেরেছে; যা একইসাথে তাদের শক্তিশালী ব্যবসায়িক পারফর্ম্যান্স নির্দেশ করে।
পাঠাও-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও ফাহিম আহমেদ বলেন, “মূল্যস্ফীতির চাপ এবং চ্যালেঞ্জিং পরিবেশের মধ্যেও গ্রাহকদের সন্তুষ্টির প্রতি নিরলস মনোযোগের কারণে গত এক বছরে পাঠাও রাইডস (বাইক এবং কার) শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির মুখ দেখেছে।”
দেশের ভিতর সম্পূর্ণ লাইসেন্সপ্রাপ্ত রাইড শেয়ারিং কোম্পানি হওয়ার পাশাপাশি গ্রাহকদের ভাড়া নিয়ে মধ্যস্ততা এবং চালকদের আয় বৃদ্ধির সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে গত এক বছরে পাঠাও পাঁচ গুণ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বলে জানান তিনি।
এদিকে লাইসেন্স নবায়নের জন্য যাত্রী সার্ভিস লিমিটেড, চালডাল লিমিটেড এবং ওভাই সলিউশন লিমিটেডের আবেদন বর্তমানে মুলতবি রয়েছে।
চালডাল লিমিটেডের ডেপুটি ডিরেক্টর শাহরিয়ার রুবায়েত বলেন, “২০২২ সালে আমাদের নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে এবং ২০২৩ সালের আবেদনটি এখনও মুলতবি।”
রাইড শেয়ারিং কমে যাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “২০১৯ সালে রেজিস্ট্রেশনের পর কাজ বন্ধ করতে বাধ্য করার আগে প্রায় ছয় মাস আমরা কার্যক্রম চালিয়েছি। উবার এবং পাঠাও-এর আক্রমণাত্মক (অ্যাগেসিভ) বিপণন কৌশল আর অফ-অ্যাপ রাইডের হার বাড়তে থাকায় আর্থিকভাবে আমাদের কার্যক্রম চালানো কঠিন হয়ে যায়।”
যাত্রী সার্ভিস লিমিটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট গোলাম ইশফাক বলেন, “তিন মাস আগে আমরা বিআরটিএ-তে আমাদের নবায়নের আবেদন জমা দিয়েছিলাম, যা এখনও মুলতবি। স্বল্প দূরত্বের পরিবর্তে আমরা এখন ইন্টারসিটির মতো দীর্ঘ দূরত্বের ট্রিপে ঝুঁকেছি।”
তার পর্যবেক্ষণ বলে, “বাইক রাইডের চাহিদা কমলেও কার রাইডের ধারায় পরিবর্তন আসেনি।”
অন্যদিকে ওভাই সলিউশনের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (কর্পোরেট এবং রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) সৈয়দ ফকরুদ্দিন মিল্লাত বলেন, নবায়ন পদ্ধতির জটিলতা আর বিআরটিএ’র সিস্টেমে প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে ওভাইয়ের নিবন্ধন নবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
কোম্পানিটি তার বাইক রাইডিং পরিষেবা স্থগিত রেখেই গত সপ্তাহে লাইসেন্স নবায়নের আবেদন করে। ওভাই সলিউশনস এখন গাড়ি ও সিএনজি (থ্রি-হুইলার) রাইড পরিষেবা এবং ডেলিভারি সার্ভিসের সেবা দিচ্ছে।
মিল্লাত বলেন, আসলে করোনা মহামারির পর থেকেই অ্যাপের মাধ্যমে বাইক ডাকার প্রবণতা কমেছে। পাশাপাশি রাইডারদের কিছু অপ্রত্যাশিত চর্চা সমাধানের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন তিনি।
তার মতে, বিআরটিএ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টায় এসব সমস্যা কার্যকরভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব।
এদিকে, বিআরটিএ সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, বৈধ অনুমতি ছাড়া কাউকে রাইড-শেয়ারিং পরিষেবা চালাতে দেয়া হবেনা, প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র এবং সড়ক নিরাপত্তা পরিচালক মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, “যে কোম্পানিগুলো তাদের রেজিস্ট্রেশন নবায়ন করেনি, তাদের ভবিষ্যতে কার্যক্রমের অনুমতি দেওয়া হবে না। এটা স্পষ্ট যে ব্যবসা পরিচালনা করতে অবকাঠামোগত সংকটের কারণেই তারা তাদের সার্ভিস নবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে।”
একাধিক রাইড শেয়ারিং কোম্পানি বিআরটিএ’র জটিলতা এবং প্রযুক্তিগত ত্রুটি নিয়ে যে অভিযোগ করেছে সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছু সমস্যা ছিল কিন্তু কয়েক সপ্তাহ আগে বিআরটিএ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বৈঠকে সেসব সমাধান করেছে। এখন সম্পূর্ণ নবায়ন প্রক্রিয়া ঘরে বসেই অনলাইনে সম্পন্ন করা যাবে।
মুলতবি থাকা আবেদনগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, “তারা (কোম্পানিগুলো) হয়তো প্রয়োজনীয় কোন কাগজপত্র জমা দিতে পারেনি। সমস্ত কাগজ ঠিকঠাক জমা দিলে, তাদের রেজিস্ট্রেশন নবায়ন করা হবে।”
যদিও কিছু কোম্পানি এখনও তাদের অবকাঠামো উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় রয়েছে, যা তাদের নবায়নের প্রচেষ্টাকে বিলম্বিত করছে।
আকিজ অনলাইন লিমিটেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক ইফতেখার হোসেন জানান, “আমরা প্রাথমিকভাবে ২৬০ জন গ্রাহক নিয়ে শুরু করেছিলাম কিন্তু পরে অ্যাপ ডেভেলপমেন্টের প্রযুক্তিগত সমস্যায় পড়ি। অ্যাপটির মন্থর গতি এবং ঘন ঘন হ্যাং হয়ে যাওয়া আমাদের পিছিয়ে দেয়।”
“তখন থেকেই আমরা এ সমস্যার সমাধান এবং অ্যাপ ডেভেলপমেন্টে সহায়তার জন্য একটি বিদেশী কোম্পানির খোঁজ করছিলাম। ইতিমধ্যে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সন্ধান আমরা পেয়েছি। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি আবার আমাদের বাজারে প্রবেশের ইচ্ছা আছে। আমরা বিআরটিএর সাথে দু’বার যোগাযোগ করেছি, এবং যেহেতু তাদের প্রক্রিয়াটি একটু জটিল, সেজন্য নবায়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে তাদের সাথে আলোচনায় আছি”, আশা প্রকাশ করে বলেন ইফতেখার।
আরেকটি কোম্পানি কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম লিমিটেডের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ইকরাম ইকবাল জানান, যেহেতু তাদের ভবিষ্যতে রাইড-শেয়ারিং সার্ভিসের বাজারে প্রবেশের ইচ্ছা আছে, তাই ইতিমধ্যে লাইসেন্স নিশ্চিত করেছেন।
“বর্তমানে আমরা সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট পর্যায়ে রয়েছি এবং এখনও পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু করিনি। তার আগে আমরা পারমিট নবায়ন করব।”