চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত দুই বছরে হাভাল ব্র্যান্ডের ১৬২টি গাড়ি খালাস হয়েছে। রাজধানীর এসিই অটোস নামে একটি প্রতিষ্ঠান এসব গাড়ি আমদানি করেছে। কাস্টমস আইন অনুযায়ী, আমদানিকারককে বাধ্যতামূলকভাবে নতুন গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে ম্যানুফ্যাকচারিং ইনভয়েস বা উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের ইনভয়েস কপি কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করতে হয়; কিন্তু চীন থেকে আমদানি করা হাভাল ব্র্যান্ডের এসব গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে এসিই অটোস সেই ম্যানুফ্যাকচারিং ইনভয়েস দাখিল করেনি।
আমদানিকারক এই প্রতিষ্ঠানটির কয়েকটি বিল অব এন্ট্রি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, আমদানি করা হাভাল ব্র্যান্ডের গাড়িগুলো উৎপাদন হয়েছে চীনে; কিন্তু আমদানি দেখানো হয়েছে সিঙ্গাপুর ও হংকং থেকে। সিঙ্গাপুরের গ্রিনভি নামের একটি কোম্পানিকে এসব গাড়ি আমদানির উল্লেখযোগ্য এলসি দেওয়া হয়েছে। যদিও ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্য বলছে, কোম্পানিটি সেই দেশে নিবন্ধিতই হয়েছে মাত্র দুই বছর। যার মূলধন মাত্র ১ লাখ সিঙ্গাপুরি ডলার। অন্যদিকে, হংকংয়ের কোম্পানিটি সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্যই মেলেনি। অর্থাৎ এসিই অটোসের এসব গাড়ি আমদানিতে তৃতীয় পক্ষকে ব্যবহার করা হচ্ছে। একই সঙ্গে শুল্ক ফাঁকি দিতে এলসি মূল্য কম দেখানোর প্রমাণ পেয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
সূত্র জানায়, গত জুলাইয়ে চীন থেকে হাভাল ব্র্যান্ডের এসইউভি আমদানি করে এসিই অটোস। এলসি মূল্যে একেকটি গাড়ির মূল্য দেখানো হয় মাত্র ১৬ হাজার মার্কিন ডলার। তবে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের উল্লিখিত এলসি মূল্য নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয় শুল্ক কর্মকর্তাদের। এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ প্রাইস অ্যাসেসমেন্ট কমিটি গঠনের মাধ্যমে বাজার যাচাই করার উদ্যোগ নেয়। ওই অ্যাসেসমেন্ট কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এসিই অটোসের ঘোষিত ১৬ হাজার ৬৪০ ডলারের গাড়ির শুল্কায়ন মূল্য ধরা হয় ২০ হাজার ৪৫২ ডলার।
কিন্তু আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটি গত সপ্তাহে অ্যাসেসমেন্ট কমিটির নির্ধারিত দামেই শুল্ক পরিশোধ করে ওই লটের গাড়িগুলো খালাস করে নিয়ে যায়। অর্থাৎ ইন্টারনেট দাম পর্যালোচনা ও বাংলাদেশের বাজার হিসাব করে এভাবে ২০২২ সালে হাভাল এইচ সিক্স পেট্রোল মডেলের ৫৪টি গাড়িতে প্রায় ৩ হাজার ৮১২ ডলার কম মূল্য দেখায় প্রতিষ্ঠানটি। চলতি বছর জুলাইয়েও একই মডেলের ছয়টি গাড়ি খালাস নেওয়া হয়।
এ ছাড়া সর্বশেষ গত আগস্টের মাঝামাঝিতে জুলিয়ন মডেলের সাতটি গাড়ি খালাস হয়। এসিই অটোস এসব গাড়ির এলসি মূল্য ঘোষণা দেয় ১০ হাজার ৪০০ ডলার; কিন্তু অ্যাসেসমেন্ট কমিটির পর্যালোচনায় তার বাজারমূল্যের সন্ধান পায় ১৩ হাজার ৩২৩ ডলার। অর্থাৎ এখানেও গাড়ির ঘোষণা মূল্য কম দেখায় ২ হাজার ৯২৩ ডলার। শেষ পর্যন্ত আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটি অ্যাসেসমেন্ট কমিটির নির্ধারিত দামেই গাড়িগুলো শুল্কায়ন শেষে খালাস নেয়।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন গাড়ি আমদানিতে ম্যানুফ্যাকচারিং ইনভয়েস কপি না থাকলে গাড়ির আসল দাম কত তা জানা যায় না। একইভাবে সেটির বাজারমূল্য বের করাও বেশ কঠিন। তা ছাড়া এ প্রক্রিয়ায় এলসি মূল্য কম দেখালে গাড়ির ন্যায্য শুল্কায়নও সম্ভব হয়ে ওঠে না।
এসব অনিয়ম ও অভিযোগ সম্পর্কে এসিই অটোসের বক্তব্য জানতে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আজহারুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে দফায় দফায় যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে গত শুক্রবার বিষয়টি উল্লেখ করে তার মোবাইল ফোনে খুদেবার্তা পাঠিয়ে বক্তব্য জানার চেষ্টা করলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।
কাস্টম হাউস সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত শুধু চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হাভাল ব্রান্ডের ১৬২ গাড়ি দেশে ঢুকেছে। এর মধ্যে ২০২২ সালে হাভাল এইচ-৬ হাইব্রিড আমদানি হয়েছে ২৪টি, হাভাল এইচ-৬ পেট্রোল ৫৪টি, হাভাল জুলিয়ন আমদানি হয়েছে ৩৩টি। আর ২০২৩ সালে এ পর্যন্ত হাভাল এইচ-৬ হাইব্রিড এসেছে ২০টি এবং হাভাল এইচ-৬ পেট্রোল আমদানি হয়েছে ছয়টি। এ ছাড়া হাভালের জুলিয়ন মডেলের গাড়ি আমদানি হয়েছে ১৪টি। পরবর্তী সময়ে হাভালের এইচ-৬ হাইব্রিড মডেলের আরও ১১টি গাড়ি আমদানি করেছে এসিই অটোস। আর প্রতিটি গাড়িতে কম মূল্য ঘোষণা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান বলেন, ‘নতুন গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে ম্যানুফ্যাকচারার ইনভয়েস বাধ্যতামূলক; কিন্তু হাভালের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ম্যানুফ্যাকচারার ইনভয়েস দিতে পারছে না। যার কারণে বাধ্য হয়ে আমরা ইন্টারনেট তথ্য পর্যালোচনা এবং বাজারমূল্য যাচাইয়ের মাধ্যমে শুল্কায়ন করছি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান সম্প্রতি একটি আলোচনায় বলেছেন, ‘মেটেরিয়েলস বা শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। অথচ বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি হচ্ছে।’ এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, ‘শতভাগ এলসি মার্জিনের পরও দেশে বিলাসবহুল পণ্য গাড়ি আমদানি থেমে নেই।’