বাংলাদেশে বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি নিবন্ধনের অনুমতি দেয়া হয় ২০২০ সালে। আর ২০২১ সালের অক্টোবরে প্রথমবারের মতো একটি বিদ্যুচ্চালিত গাড়ির নিবন্ধন দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। নিবন্ধনের অনুমতি দেয়ার পর গত ১৩ মার্চ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ বছরে সারা দেশে নিবন্ধিত বিদ্যুচ্চালিত গাড়ির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সব মিলিয়ে ৩৯৬টিতে।
বিআরটিএর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নিবন্ধিত এসব বিদ্যুচ্চালিত গাড়ির মধ্যে রয়েছে ২৪৩টি মোটরসাইকেল, ৯৪টি হার্ড জিপ, ৫৪টি প্রাইভেট কার, তিনটি মাইক্রোবাস ও একটি করে ডেলিভারি ভ্যান ও অটোরিকশা।
প্রয়োজনের তুলনায় গত পাঁচ বছরে দেশে বিদ্যুচ্চালিত মোটরযান এসেছে নেহাতই হাতে গোনা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকা এবং আরোপিত আমদানি শুল্কের কারণে দেশে বিদ্যুচ্চালিত যানবাহনের প্রসার ঘটছে না।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়াউর রহমান খান বলেন, ‘বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি বাংলাদেশের জন্য নতুন প্রযুক্তি। এখানে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করতে মানুষের সময় লাগবে।’
বাংলাদেশে বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি চার্জ করার মতো পর্যাপ্ত স্টেশন নেই, মেরামত করার জন্য প্রয়োজনীয় ওয়ার্কশপ নেই, তাহলে কেন মানুষ এখানে বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি কিনবে প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘অন্যান্য দেশে যেটা করে, প্রণোদনা দিয়ে বিদ্যুচ্চালিত গাড়ির প্রসার ঘটায়। বাংলাদেশেও কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তার পরও এখানে দামটা অনেক বেশি পড়ে যায়। কর অব্যাহতি, প্রণোদনার ব্যবস্থার পাশাপাশি বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারলে দেশে বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করবে।’
দেশে বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি প্রসারের লক্ষ্যে ২০২৩ সালে ‘ইলেকট্রিক মোটরযান রেজিস্ট্রেশন ও চলাচলসংক্রান্ত নীতিমালা’ প্রণয়ন করে সরকার। এ নীতিমালার ভূমিকায় বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে সড়ক পরিবহন খাতে ব্যবহৃত যানবাহনের ন্যূনতম ৩০ শতাংশ ইলেকট্রিক মোটরযান ক্যাটাগরিতে রূপান্তর করা প্রয়োজন।
সরকারি নীতিমালায় ‘এক বা একাধিক মোটরের সাহায্যে চালিত মোটরযান, যার চালিকাশক্তি সেই বৈদ্যুতিক চার্জ বা সংযুক্ত ব্যাটারি’—এ ধরনের যানবাহনকে বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি বা ‘ইলেকট্রিক মোটরযান’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এ নীতিমালায় বাইসাইকেল বা রিকশা ভ্যান ইলেকট্রিক মোটরযান হিসেবে অভিহিত হবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, বিআরটিএ থেকে নিবন্ধনের জন্য মোটরযানের যেসব শ্রেণী রয়েছে, সেসব শ্রেণীর বিদ্যুচ্চালিত নিবন্ধনের যোগ্য হবে। বর্তমানে দেশের সড়ক-মহাসড়কে যেসব ব্যাটারিচালিত রিকশা, থ্রি-হুইলারের মতো যানবাহন চলাচল করছে, সেগুলো বিদ্যুচ্চালিত যানবাহন হিসেবে এ সংজ্ঞায় পড়বে না বলে জানিয়েছেন বিআরটিএর কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশে সরকারিভাবে বিদ্যুচ্চালিত বাস কেনার দুটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল বিগত সরকারের আমলে। রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) মাধ্যমে ১০০ বিদ্যুচ্চালিত বাস কেনার একটি প্রকল্প নেয়া হলেও স্থগিত করা হয়েছে। বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটি করিডোরের জন্য বিদ্যুচ্চালিত বাস কেনার পরিকল্পনা থাকলেও এখন কেনা হচ্ছে ডিজেলচালিত গাড়ি।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বিআরটিসির জন্য সরকারি অর্থায়নে ১০-১২টি বিদ্যুচ্চালিত বাস কেনার একটি উদ্যোগ রয়েছে। এর বাইরে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে রাজধানী ঢাকায় চালানোর জন্য ৫০০ বিদ্যুচ্চালিত বাস কেনার আরেকটি উদ্যোগ চলমান রয়েছে। এ প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ১ জুলাই ২০২৫ থেকে ৩০ জুন ২০৩০ পর্যন্ত। বাস সংগ্রহ, ডিপো নির্মাণ, আইটিএস ও বাস পরিষেবা পুনর্গঠনের কাজে ১১০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
দেশে বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি প্রসারের জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে জানিয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীন বলেন, ‘বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি প্রসারের কাজে সরকারের অনেকগুলো সংস্থা জড়িত। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, জ্বালানি বিভাগ পৃথকভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজ করেছে। বিআরটিএর দায়িত্ব শুধু এসব যানবাহন নিবন্ধন দেয়া ও চলাচল নিয়ন্ত্রণ।’
বিদ্যুচ্চালিত যানবাহনের প্রসারে সরকার কেন্দ্রীয়ভাবে সবগুলো অংশীদারদের সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় কাজগুলো এগিয়ে নিচ্ছে বলে এ সময় মন্তব্য করেন তিনি।