মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান ‘নগদ লিমিটেড’ ব্যাংকে জমা টাকার অতিরিক্ত ৬৪৫ কোটি টাকার ই-মানি তৈরি করেছে। পাশাপাশি অনুমোদনবিহীন পরিবেশকের মাধ্যমে ১ হাজার ৭১১ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। এটাকে ডিজিটাল জালিয়াতি বলা হলেও এখনো কোনো মামলা দায়ের হয়নি। কারণ, মামলা কে করবে তা নিয়ে এক মাস ধরে ডাক অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে।
এ ঘটনায় ইতিমধ্যে নগদ লিমিটেডের ৪১ পরিবেশক ও ২৪ হাজার ৯৭ এজেন্টকে বরখাস্ত করেছে প্রতিষ্ঠানটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিযুক্ত প্রশাসক। পাশাপাশি ৬৪৩ জন বিক্রয় কর্মকর্তাকেও বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া শীর্ষ পর্যায়ের ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ডাক অধিদপ্তরের কাছে সুপারিশ করেছেন নগদের প্রশাসক।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নগদ লিমিটেডের যাত্রা শুরু হয়। ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ এই এমএফএস সেবার উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিষ্ঠানটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই ব্যবসা শুরু করে। এটির পরিচালনায় প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগের একাধিক সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি যুক্ত ছিলেন। ফলে হিসাব খোলা থেকে শুরু করে সরকারি ভাতা বিতরণে একচ্ছত্র সুবিধা পায় নগদ। এই সুযোগে বড় ধরনের অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২১ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটিতে প্রশাসক বসায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর প্রশাসক দলের পরিদর্শনে বড় ধরনের ডিজিটাল আর্থিক জালিয়াতি ধরা পড়ে। সে জন্য গত ১৮ নভেম্বর আইনি ব্যবস্থা নিতে ডাক অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেন প্রশাসক। তবে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ নিয়ে ইতিমধ্যে একাধিক সভাও হয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, ‘আমরা নগদের ঘটনা সম্পর্কে অবগত। এই ঘটনায় কে মামলা করবে, সেই সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ডাক অধিদপ্তরের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। আইনজীবীর মতামত নেওয়া হচ্ছে। এরপরই সিদ্ধান্ত হবে।’
শাস্তি যা হলো
ডাক অধিদপ্তর ও থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির মধ্যে ২০১৭ সালে হওয়া এক চুক্তি অনুযায়ী, ব্যাংকে যত টাকা জমা থাকবে ঠিক তার সমপরিমাণ ই-মানি ইস্যু করা যাবে। তবে প্রশাসক দল পরিদর্শনে দেখতে পায়, ব্যাংকে যে টাকা জমা আছে তার চেয়ে অতিরিক্ত ৬৪৫ কোটি টাকার ই-মানি ইস্যু করেছে নগদ।
এ ছাড়া নথিপত্র পর্যালোচনায় উঠে আসে, অনুমোদন ছাড়াই নগদে ৪১ পরিবেশকের মাধ্যমে ১ হাজার ৭১১ কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে। মূলত ই-মানির বিপরীতে নগদ টাকা তুলে নেওয়া হয়। এসব পরিবেশকের দায়িত্ব ছিল সরকারি ভাতা বিতরণ করা। এই ডিজিটাল আর্থিক জালিয়াতির ঘটনায় ৪১ পরিবেশকের পাশাপাশি ২৪ হাজার ৯৭ এজেন্টকেও বরখাস্ত করেছেন নগদে নিযুক্ত প্রশাসক। ৩ হাজার ৮৩১টি মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট বা ব্যবসায়িক হিসাব বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া নগদের ৬৪৩ জন বিক্রয় কর্মকর্তাকেও বরখাস্ত করা হয়েছে।
এদিকে যেসব গ্রাহক যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়া নগদে হিসাব খুলেছিলেন তাঁদের হিসাবগুলো এখন হালনাগাদ করা হচ্ছে। যথাযথভাবে হিসাব না খোলায় অনেকের হিসাব স্থগিত করা হয়েছে।
নগদে সংঘটিত অনিয়ম টাকার পরিমাণে দেশের সবচেয়ে বড় ‘ডিজিটাল আর্থিক জালিয়াতি’। তাই নগদে ফরেনসিক নিরীক্ষার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফরেনসিক নিরীক্ষা হলো, কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের বিস্তারিত খতিয়ে দেখা, যার মাধ্যমে জালিয়াতি, অনিয়ম ও সুবিধাভোগীদের খুঁজে বের করা সম্ভব হয়।
জানা গেছে, নগদের মালিকানায় আওয়ামী লীগের নেতারা যুক্ত থাকায় তৎকালীন সরকার বিভিন্ন ভাতা বিতরণের জন্য নগদকে বেছে নিয়েছিল। আর এ সুযোগে সরকারি ভাতার একটা অংশ নিয়েও জালিয়াতি করা হয়। বিশেষ করে হিসাবে টাকা দেওয়ার পর যেসব ভাতাভোগী তিন দিনের মধ্যে তা উত্তোলন করেননি তাঁদের টাকা তুলে নেয় নগদ।
তবে জালিয়াতির কারণে যে আর্থিক দায় তৈরি হয়েছে তা পড়ে ডাক অধিদপ্তরের ঘাড়ে। কারণ, নগদকে মোবাইলে আর্থিক সেবা প্রদানের সাময়িক অনুমতিপত্র তারাই দিয়েছে। ডাক অধিদপ্তরের পক্ষে সেবাটি পরিচালনা করে নগদ লিমিটেড, একসময় এটির নাম ছিল থার্ড ওয়েভ টেকনোলজি লিমিটেড।