দেশের অন্যতম মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আদালতের স্থগিতাদেশে স্থবির হয়ে পড়েছে নিয়ন্ত্রকের প্রশাসন। আর এই সুযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের জালিয়াতির মামলার এক আসামিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে।
হাইকোর্ট সম্প্রতি নগদে প্রশাসক নিয়োগের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা এক রিটে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসক বসানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন। ফলে ব্যাংকটির নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসক দল নগদ পরিচালনা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ডাক বিভাগও এর ওপর আর নিয়ন্ত্রণ রাখেনি।
স্থগিতাদেশের সুযোগে গত সোমবার নগদের সাবেক পরিচালক মো. সাফায়েত আলমকে সিইও হিসেবে নিয়োগ দেয় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ। সাফায়েত আলম বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়ের করা আর্থিক জালিয়াতির মামলার এক নম্বর আসামি। সিইও হওয়ার পরপরই তিনি দায়িত্ব নিয়ে মানবসম্পদ বিভাগের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেন এবং নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ করেন।
গত দুই দিনে নগদ থেকে শীর্ষ পর্যায়ের ১৯ জন কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছেন। মামলার আরও দুই আসামিকেও আবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে নগদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘জনগণের টাকার নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। প্রশাসক বসিয়ে আমরা সে কাজটিই করছিলাম। আদালতের আদেশের কারণে আমাদের সে দায়িত্ব থেকে সরতে হয়েছে। আমরা আদেশ প্রত্যাহারের আবেদন করেছি।’
২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার হিসাব মিলছে না
নগদে প্রশাসক বসানোর পর যে অডিট হয়, তাতে বড় ধরনের জালিয়াতি ধরা পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, নগদ অতিরিক্ত ৬৫০ কোটি টাকা ই-মানি তৈরি করে যা সম্পূর্ণ অবৈধ। পাশাপাশি ভুয়া পরিবেশক ও এজেন্ট দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণও পাওয়া যায়।
প্রতিষ্ঠানটি সরকারি ভাতা বিতরণে ২ হাজার কোটি টাকার লেনদেন গোপন করেছে, যা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নিরীক্ষাতেও উঠে এসেছে। সব মিলিয়ে নগদের ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার হিসাব মেলেনি বলে দাবি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
মামলা, প্রভাবশালী সংশ্লিষ্টতা ও নিয়ন্ত্রণহীনতা
২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে, যার মধ্যে রয়েছেন:
-
নগদের সাবেক চেয়ারম্যান
-
সাবেক সিইও
-
ডাক বিভাগের আটজন সাবেক ও বর্তমান ডিজি
-
প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ
এসব অনিয়মের ঘটনা ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে, যখন ‘নগদ’ একচেটিয়াভাবে বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছিল। আদালতে থাকা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট সম্প্রতি প্রশাসক নিয়োগের বৈধতা বাতিল করে স্থগিতাদেশ দেন। এরপরই প্রতিষ্ঠানটি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে।
কিভাবে শুরু নগদের
২০১৮ সালে ডাক অধিদপ্তর নগদ চালুর অনুমতি চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করে। ব্যাংক তখন শর্ত পূরণ না করায় অনুমোদন দেয়নি। পরে ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ ডাক অধিদপ্তর নিজস্ব আইন পরিবর্তন করে ‘নগদ’ নামে এমএফএস চালু করে।
২০২০ সালের মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংক শর্তসাপেক্ষে নগদকে অন্তর্বর্তীকালীন অনুমোদন দেয়। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী ব্যাংক হিসাব না খোলার পরও কোনো তদারকি ছিল না। বর্তমানে নগদ দৈনিক প্রায় এক হাজার কোটি টাকা লেনদেন করে এবং দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এমএফএস সেবা হিসেবে কাজ করছে।
সামনে কী?
বাংলাদেশ ব্যাংক হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন করেছে, যার শুনানি ১৯ মে নির্ধারিত। এ পর্যন্ত নগদ গ্রাহকদের জন্য সেবা সচল থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্ব, দায়বদ্ধতা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।