উৎসব প্রিয় বাঙালিরা একসময় ধর্মীয় উৎসব (ইদ-পূজা) আর পহেলা বৈশাখ কেন্দ্রিক কেনাকাটা করলেও যুগের সাথে তালমিলিয়ে বাড়িয়েছে দিবস কেন্দ্রিক কেনাকটা। প্রতিটি উৎসবে পোশাক, গয়না, ফুল, খাবার কেনাকাটা সহ ঘুরে বেড়ানোর ভিন্ন ভিন্ন পরিকল্পনা থাকে উৎসব প্রিয়দের।
একটা সময় শপিং মহল গুলোতে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় থাকলেও অনলাইন কেনাকাটার সুবিধা বদলেছে চিত্র। মানুষ এখন ঘরে বসে পেয়ে যায় নিজের পছন্দের পরিদেয় পোশাক, উপহারসামগ্রী, নিত্য পণ্য সহ সবকিছু। পুরান ঢাকার বাসিন্দা শামীম আরা ডালিয়া টেকজুম কে জানায়, ২১শের বসন্ত আমাকে ছুয়েছে দেশীয় পণ্যের সাথে। একাধিক ডিজাইনের হলুদ শাড়ি ও বাসন্তি গহনা ক্রয় করেছি অনলাইন থেকে। দেশি শাড়ি অনেক সুন্দর ও আরামদায়ক। দাম সাধ্যের মধ্যে এবং কোয়ালিটির দিক থেকে সেরা।
তিনি আরও বলেন, কিছুদিন আগেও বিদেশী পণ্যের প্রতি নিজেদের অর্থ আর ভালোবাসা বিলিয়ে দিতাম। বর্তমানে দেশি পণ্য স্থান পেয়েছে সর্বত্রে। হয়তো নানি-দাদি হয়ে নাতি নাতনিদের সাথে গল্প করবো- ”আপনকে পর করে, পর কে করেছিলাম আপন (এক সময় দেশী পণ্য ক্রয় ও ব্যবহার করেছি)। শপিং মলে গিয়ে শপিং করতে হয় না। অনলাইন শপিং করলে ঘরে বসে পেয়ে যাই পার্সেল।”
বসন্ত উৎসবকে কেন্দ্র করে অনলাইন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান গুলো মূল্য ছাড় ও অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে থাকে ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়াতে। ক্রেতার চাহিদা বুঝে নিজেদের পেজ-ওয়েবসাইটে আনেন রং ও ঢঙ পোশাকের বাহার। শাড়ি, পাঞ্জাবি, গয়না, সালোয়ার-কামিজ, কুর্তি, ফ্যামিলি ম্যাচিং পোশাক সহ বিভিন্ন ফিউশন রাখেন ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে। প্রিয়জনকে দেওয়ার জন্য অনলাইন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান গুলো উপহারসামগ্রীও রাখেন। ক্রেতারা ক্লিক বা মেসেজ করে পেয়ে যায় সবকিছু। এ প্রতিবেদন লেখার পূর্বে কথা হয়েছে কয়েকজন দেশি পণ্যের অনলাইন বিক্রেতার সঙ্গে।
অনলাইনে দেশি শাড়ি নিয়ে কাজ করেন কন্যাসুন্দরির সত্ত্বাধিকারী মনিকা আহমেদ। তিনি টেকজুম কে বলেন, এবারের বসন্ত উপলক্ষ্যে শাড়ীর রঙে কিছুটা ভিন্নতা এনেছি। শাড়ীতে হলুদ রঙ ঠিক রেখে বেগুনী, সবুজ, শ্যাওলা, মেরুন সহ অন্যান্য কালার যোগ করেছিলাম। রঙের ভিন্নতা আনায় এবারের বসন্তে বেচাকেনা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে।
আরিয়াস কালেকশনের স্বত্বাধিকারী নিগার ফাতেমা বলেন, গত নভেম্বর থেকে বসন্তের ডিজাইন শুরু করেছি। জানুয়ারি থেকে বিক্রয় শুরু হয়েছে। খেশ শাড়ি, পাঞ্জাবি ও ফ্যামিলি ম্যাচিং পোশাক বিক্রি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। আজ বহু ক্রেতার ফেসবুক প্রোফাইলে দেখেছি খেশ পোশাকের মনজুড়ানো ছবি।
উম্মে সাহেরা এনিকার উদ্যোগের নাম তেজস্বী। তিন কাজ করেন মূলত বাটিকের শাড়ী, থ্রি-পিছ, শার্ট, ফতুয়া, সেন্ডেল ইত্যাদি নিয়ে। টেকজুম কে তিনি বলেন, তেজস্বী এবারই বসন্ত উপলক্ষে ছেলে-মেয়ে উভয়ের টাইডাই বাটিকের তৈরী পোশাক এনেছে অনলাইনে। হলুদ, কমলা, লাল রং এর প্রাধান্য থাকলেও মেজেন্টা, ফিরোজার মত গাঢ় রং এর পাশাপাশি অলিভ, এ্যাশ এর হালকা রং এর পোশাক তৈরী করেছি। হালকা রং এর প্রতি ক্রেতাদের আর্কষণ ও ভালোলাগা রয়েছে। পোশাকের সাথে মিল রেখে তেজস্বীর বাটিক সেন্ডেল নিয়েছে ক্রেতারা।
টেস্টবিডির সত্ত্বাধিকারী সালমা নেহা টেকজুম কে বলেন, শুরুটা খাবার নিয়ে হলেও ই-ক্যাবের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সভাপতি রাজিব আহমেদ স্যারের পরামর্শে চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি দেশীয় শাড়ি নিয়ে কাজ শুরু করেছি। শাড়ির শুরু টা ছিল বসন্ত কালেকশন দিয়ে। অল্প সময়ে দুইটা ডিজাইন করে ক্রেতাদের থেকে ভালো সাড়া পেয়েছি। কালেকশনে ছিলো হাফ সিল্ক ও সুতি শাড়িতে কাঠের ব্লক সাথে নকশী সুতোর কাজ। এ বসন্তে ক্রেতাদের পছন্দ, রুচি, রং, ডিজাইন সম্পর্কে অর্জিত অভিজ্ঞতা আগামী তে আরও ভালো সাফল্য আসবে আশা করি।
শারমিন ইসলাম অমির উদ্যোগের নাম তাঁতকন্যা। তিনি কাজ করেন তাঁত ও বাটিকের শাড়ি, থ্রিটিস, পাঞ্জাবি ইত্যাদি নিয়ে। তিনি টেকজুম কে বলেন, বিভিন্ন উৎসব ঘিরে থাকে তাঁতকন্যার বিশেষ আয়োজন। এবারের বসন্তে ছিলো তাঁতের শাড়ি, বাটিক শাড়ি এবং নিজস্ব ডিজাইনের কিছু কালেকশন। শাড়ি ও থ্রি-পিস বিক্রি হলেও লাল, হলুদ, মেরুন রঙ এর শাড়ি গুলো প্রাধান্য পেয়েছে।
আবায়া স্টোরির সত্ত্বাধিকারী সিরাজুম মুনিরার সাথে কথা বলে জানা গেছে, বসন্ত উৎসব মাথায় রেখে আবায়া স্টোরি নানা রঙ এর দেশীয় হিজাবের পশরা সাজিয়েছিল। দেশীয় স্লাব কটন, পার্টি হিজাব, পাশমিনা হিজাব গুলোতে প্রকৃতির সব রঙ খুজে পাওয়া যায়৷ বাসন্তী রঙ এর পাশাপাশি লাল, হলুদ, সবুজ ও কমলা হিজাবে ব্যাপক সাড়া পেয়েছি।
কাকলী’স এটিয়্যার এর স্বত্বাধিকারী কাকলী রাসেল তালুকদার বলেন, পেন্ডামিক সিচুয়েশনের প্রভাব বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির উপর পরলেও আমাদের দেশীয় পণ্যের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির উপর খুব একটা নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট রাখতে পারছেনা। বিশেষ করে আমাদের সংস্কৃতির অংশ বিভিন্ন পূজা পার্বণে আমাদের দেশীয় শাড়ির কদর বেড়েছে। এই ফাল্গুনেও দেশীয় শাড়ির আধিক্য দেখা গিয়েছে সর্বত্র। কাকলী’স এটিয়্যার এ ফাল্গুনের প্রস্তুতি ছিলো গত বছর নভেম্বর থেকে। এই তিন মাসে ফাল্গুন স্টকের প্রায় ৯৮% জামদানি শাড়ি বিক্রি হয়েছে। জামদানি ঐতিহ্যগত ভাবে আমাদের সংস্কৃতির অংশ। ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির কল্যাণে ঘরে বসে মানুষ পছন্দের পোশাক পাচ্ছে তাই বেচাকেনা এখন আরও সহজ হয়ে গিয়েছে।
পরিধান শৈলীর স্বত্বাধিকারী রাকিমুন বিনতে মারুফ জয়া জানায়, বসন্ত উৎসব নিয়ে সবার মধ্যেই একটা অন্যরকম আমেজ থাকে। বাঙালি নারীদের প্রিয় সাজ বাসন্তী কিংবা হলুদ রঙের শাড়ি আর খোপায় গাঁদা ফুল। বসন্তে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে হাফসিল্কের উপর স্ক্রিনপ্রিন্ট করে ভ্যালু এ্যাড করা শাড়িগুলো এবং একরঙা হাফসিল্কের সাথে বাহারি রঙের স্ক্রীনপ্রিন্ট ব্লাউজ পিস। এবারের বসন্ত উৎসবের বিক্রি থেকে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি দিন দিন বাড়ছে দেশি তাঁতের শাড়ির চাহিদা।
শীতের বিদায় জানাতে আর গ্রীষ্মকে বরণ করতে আসে বসন্ত। এ ঋতুতে নানা সাজে নিজেকে সাজায় প্রকৃতি। বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে পহেলা ফাল্গুন শুরু হয় স্পেশাল দিন হিসেবে তাই বসন্তের প্রথম দিনে থাকে নানা আয়োজন। প্রিয় জনদের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানানো হয় ফুল ও উপহার দিয়ে।
বসন্ত উৎসবের সাথে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনের নাম জড়িয়ে আছে। ১৪০১ বঙ্গাব্দ থেকে বাংলাদেশে ‘বসন্ত উৎসব’ উৎসব শুরু হয়েছে।