ইন্টারনেট তথা ফেসবুক কে কাজে লাগিয়ে দেশের ৬৪ জেলায় কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ খাদি কাপড় ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে গত ৬ এপ্রিল পরিধান শৈলী ফেসবুক গ্রুপে ”খাদি ওয়েভ” ঘোষণা দেয় ই-ক্যাবের সাবেক ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাজিব আহমেদ। এতে অংশ নিয়েছে গ্রুপ মেম্বার ও উদ্যোক্তারা। সরাসরি বিক্রয় পোস্ট না দিয়ে নিজেদের খাদি কাপড় পরিহিত ছবি পোস্ট করে ওয়েভ সফল করেছেন। এরফলে মাত্র দশ দিনে খাদি ওয়েবে কয়েক হাজার ছবির আর্কাইভ জমা হয়, ফেসবুক গ্রুপ পরিধান শৈলীতে।
খাদি ওয়েভ সফল করতে সাধারণ মেম্বার ও উদ্যোক্তারা পরিধান শৈলী গ্রুপ সহ নিজেদের ফেসবুক প্রোফাইলে নিয়মিত পোস্ট কমেন্ট করেছে। এতে ইন্টারনেটে তৈরি হয়েছে খাদি কাপড়ের আগণিত কনটেন্ট, বেড়েছে প্রচার, হয়েছে ক্রেতা ও সম্ভাব্য ক্রেতা। ওয়েভ চলাকালীন সময়ে খাদি শাড়ি, পাঞ্জাবি আর গজ কাপড়ের নতুন কাস্টমার ও অর্ডার পেয়েছে ফেসবুক ভিত্তিক উদ্যোক্তারা।
ফেসবুকে সুন্দর সুন্দর ছবি দেখে খাদি কাপড় কেনাকাটায় দেশ বিদেশ থেকে আগ্রহী হয়েছে ক্রেতারা। তাদের একজন আমেরিকা প্রবাসী শারমিন আরা। খাদি ওয়েভের কেনাকাটা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ”আমেরিকা থেকে প্রায় এক বছর ধরে অনলাইনে দেশি পণ্য কেনাকাটা করছি। প্রতি বছর আম্মার জন্য কেনাকাটার বরাদ্ধ থাকলেও এবার আম্মা নেই পৃথিবীতে। তাই পরিকল্পনা ছিল, বরাদ্দের অর্থ দিয়ে অন্যদের উপহার দেবো। খাদি ওয়েভে চমৎকার কিছু পাঞ্জাবিতে আটকে যায় চোখ। এসব খাদি পাঞ্জাবি যাদের কে উপহার দেওয়া হয়েছে তারাও পছন্দ করেছে। আমি বলতে চাই খাদি ওয়েভে আমার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে।”
সদ্য চালু হওয়া ”নকশিওয়ালা” পেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রতাপ পলাশ ওয়েভ নিয়ে বলেন, এই খাদি ওয়েব এর ফলে দূইটা বেশ বড় ইতিবাচক ঘটনা ঘটেছে প্রথমত, প্রচুর ইউজার জেনারেটেড কনটেন্ট তৈরি হয়েছে, মানে খাদি পোশাক এর ছবি, ভিডিও, লেখা। দিতীয়ত, ওয়েব চলাকালীন এই নিয়ে পোস্ট এ, কমেন্টে আলোচনার ফলে এই সম্পর্কে অনেকে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন, সঠিক তথ্য পেয়েছেন বইয়ের ভাষায় যাকে বলে ক্রেতাদের জ্ঞান সংক্রান্ত প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে গেছে । এর ফলে অনেক নুতন ক্রেতা তৈরি হয়েছে, বিক্রেতারাদের ও ভালো বিক্রি হয়েছে। এই যেমন ধরুন এই ওয়েব চলাকালীন সময়ে আমার এই গ্রুপ থেকেই প্রায় সত্তর হাজার টাকার খাদি বিক্রি হয়েছে।
অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই সবাই কে দেশ ও দেশের বাহিরে থেকে আন্তরিক সাপোর্ট এর মাধ্যমে এই খাদি ওয়েব কে সফল করতে এগিয়ে আসার জন্য। অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা শ্রদ্ধেয় রাজিব আহমেদ স্যার এর প্রতি প্রতিনিয়ত অসাধারণ সব আইডিয়া দিয়ে একটা একটা করে আমাদের এই দেশি পন্য ও দেশি পন্যের ই-কমার্স কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া জন্য।
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী রবিন খান (রাফি হক) বলেন, ”আশির দশকেও খাদির যে প্রচলন ছিল, সময়ের তালে তা হারিয়ে যেতে বসেছে। খাদি ওয়েভের কারণে, বাংলাদেশের মানুষ আবার খাদি সম্পর্কে জানতে পেরেছে। এভাবেই খাদির হারানো জৌলুস ফিরিয়ে আনতে হবে। ঘরে ঘরে বাড়াতে হবে খাদির ব্যবহার। খাদির প্রতি ভালবাসা থেকেই ওয়েভে খাদি পণ্য কেনাকাটা করেছি। আশা করি, খাদি ওয়েভ থেকেই খাদি পণ্যের নতুন দিনের সূচনা হবে।”
এখাতের উদ্যোক্তারা মনে করে ওয়েভের ফলে খাদি নিয়ে প্রচুর কনটেন্ট তৈরি হয়েছে। খাদি কাপড় মোটা, গরম বেশি ইত্যাদি ধারণা গুলো ওয়েভের কারণে দূর হয়েছে। ফেসবুক ব্যবহারকরীরা ওয়েভে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করায় তাদের পছন্দ ও চাহিদা বুঝতে পেরেছেন উদ্যোক্তারা। যা খাদি কাপড়ে নতুন নতুন ফিউশন আনতে সহায়ক হবে।
কুমিল্লার মেয়ে ইশরাত জাহান রিপার উদ্যোগের নাম ”ফ্যাশন বাই রিপা”। টেকজুম কে তিনি বলেন, ”গেল সপ্তাহে ই-ক্যাবের সাবেক ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাজিব আহমেদ স্যার সাত হাজার মেম্বারের পরিধান শৈলী ফেসবুক গ্রুপে খাদি ওয়েভের ঘোষণা দেয়। নিজে মডেলি হয়ে বিক্রিয় পোস্ট না দিয়ে খাদি শাড়ি তুলে ধরি সকলের সামনে। এতে আমার বিক্রিয় হয়েছে ১ লাখ একুশ হাজার পঁচাত্তর টাকা। এটি সম্ভ্যব হয়েছে পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং এর কারণে। পরিচিতির কারণে নিজ প্রোফাইলেও বিক্রি হচ্ছে সমান তালে। ওয়েভ চলাকালীন সময় থেকে ফ্রেন্ড লিস্টে ফলোয়ার ও বিজনেস পেজে বাড়ছে লাইক সংখ্যা।“
কুমিল্লার আরেক উদ্যোক্তা জান্নাতুল ফেরদৌস ভূঁইয়ার উদ্যোগের নাম “শত সওদা ঘর”। তিনি কাজ করেন কুমিল্লার খাদি কাপড় নিয়ে। তার উদ্যোগে খাদি ওয়েভের প্রভাব কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ”আমার বিক্রিতে খাদি ওয়েভের প্রভাব সীমাহীন। খাদি ওয়েভের কারণে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে খাদিপণ্য গুলোর পোস্ট দিতে পেরেছি। এতে আমার পণ্যের প্রচার এবং প্রসার হয়েছে অনেক গুণ। ফেসবুক পোস্টে তিনি উল্লেখ করেন নিজ প্রোফাইলে ৮৩,৫০০ টাকার খাদি কাপড় বিক্রি হয়েছে।”
পরিধান শৈলী ফেসবুক গ্রুপে খাদি ওয়েভের সাফল্যের কথা উল্লেখ করে পোস্ট দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। তাদের একজন নকশী কন্যার উদ্যোক্তা শারমিন সোহেলীয়া। তিনি লিখেন, খাদি ওয়েভে গ্রুপ থেকে কোন বিক্রি না হলেও নিজ প্রোফাইলে উনিশ হাজার (১৯০০০) টাকা বিক্রি হয়েছে।
নীলাদ্রিকা ভৌমিক এক পোস্টে লিখেন খাদি ওয়েভে মোট উনচল্লিশ হাজার নয়শ (৩৯,৯০০) টাকা বিক্রি হয়েছে। লিনা’স ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী মুশফিকা লিনা লিখেন, ওয়েভে এ পর্যন্ত মোট উনচল্লিশ হাজার চারশত পঞ্চাশ (৩৯,৪৫০) টাকা বিক্রি করেছেন। দেশি ফ্যাশন জোনের উদ্যোক্তা শামীমা সুলতানা রুম্পা বাহাত্তর হাজার চারশত ত্রিশ (৭২,৪৩০) টাকা, শুকতারা এটিয়্যারের স্বত্বাধিকারী চম্পা চক্রবর্তী আঠারো হাজার (১৮০০০) টাকা, নাসরিন সুলতানা রুমা ছাব্বিশ হাজার সাতশত পঞ্চাশ (২৬,৭৫০) টাকা, বিচিত্রা রয় ষাট হাজার (৬০,০০০) টাকা বিক্রিয় পোস্ট ও কমেন্ট করেছেন পরিধান শৈলী গ্রুপে।
পরিধান শৈলী ফেসবুক গ্রুপ ঘুরে পোস্ট আর কমেন্টে পাঁচ লাখ টাকার বিক্রিয় রিপোর্ট দেখা মিলে। বিক্রেতারা পোস্ট ও কমেন্ট লিখছেন এসব সাফল্যের কথা।
পরিধান শৈলীর স্বত্বাধিকারী রাকিমুন বিনতে মারুফ জয়া খাদি ওয়েভ সম্পর্কে টেকজুম কে বলেন, “ছয় হাজার সাতশ মেম্বারের গ্রুপ পরিধান শৈলীতে ই-ক্যাবের সাবেক ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং সার্চ ইংলিশের সিইও রাজিব আহমেদ স্যারের ঘোষণায় খাদি ওয়েভ শুরু হয়ে সফল ভাবে শেষ হয়। গ্রুপের নিয়ম মেনে ক্রেতা ও বিক্রেতারা খাদি পোশাক পরিহিত ছবি শেয়ার করেছে। এতে প্রচারণা বৃদ্ধির পাশাপাশি খাদি কাপড় মোটা এবং আরামদায়ক না এমন ভুল ধারণা গুলো অনেকটাই দূর হয়েছে। বেশি বেশি পরিহিত ছবি দেখে খাদির প্রতি মানুষের আগ্রহ, আকর্ষণ এবং ভালো লাগা তৈরি হয়েছে। এতে করে খাদির উদ্যোক্তাদের পরিচিতি বিক্রি ও বেড়েছে। ওয়েভের সুফল ধরে রেখে উদ্যোক্তারা আরও বেশি উদ্যমী হলে খাদির সোনালী দিন ফিরে আসবে।”
খাদি ওয়েভ নিয়ে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশান অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর সাবেক ও প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট রাজিব আহমেদ বলেন, “কুমিল্লার খাদির খুব সুনির্দিষ্ট ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে। তবে এখনো খাদির প্রচলন ও জনপ্রিয়তা সারা দেশে তেমন ছড়ায় নি। ইন্টারনেটের (ফেইসবুক) মাধ্যমে তা দেশের ৬৪ টি জেলায় ছড়িয়ে দিতে হবে। এজন্যই মূলত খাদি ওয়েভের উদ্যোগ নেওয়া।
শুধু কিছু খাদি শাড়ি, পাঞ্জাবি আর গজ কাপড় বিক্রি করা ওয়েভের উদ্দেশ্য নয়। আসল উদ্দেশ্য হল খাদিকে সারা দেশের মানুষের কাছে পরিচিত করা।“