বাংলাদেশের প্রথম গ্রামীণ উন্নয়নে সহায়ক ই-কমার্স প্লাটফর্ম হলো ‘একশপ’। সহজে ও দ্রুত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে এটি একটি অনন্য উদ্যোগ। আইসিটি বিভাগের এটুআই প্রকল্পের আওতায় এটি চালু করা হয়েছে। ই-কমার্স ও লজিস্টিকস কোম্পানি, পোস্ট অফিস, মোবাইল ফোনে পেমেন্ট সুবিধা এবং ইউনিয়ন ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (ইউডিসি) নেটওয়ার্কের মধ্যে সমন্বয় করে তৈরি হয়েছে একশপ প্ল্যাটফর্ম।
বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জনের পথে এটি একধাপ অগ্রগতি। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের হাত ধরে বাংলাদেশে এ উদ্যোগের যাত্রা শুরু হয়। ডিজিটাল পদ্ধতিতে গ্রামীণ অতিক্ষুদ্র (মাইক্রো), ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য বিপণনের লক্ষ্যে ‘একশপ’ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর রাজধানীর আইসিটি টাওয়ারে যখন সজীব ওয়াজেদ জয় একই সাথে ‘একপে’, ‘একসেবা’ ও ‘একশপ’র আনুষ্ঠানিক যাত্রা ঘোষণা করেন; তখন দেশের কারু, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উদ্যোক্তারা ভাবতেই পারেননি, তাদের উৎপাদিত পণ্য অনলাইনে বিক্রি হবে। সেই থেকে বদলে গেছে সরকারি সেবা দান ও পণ্য বেচাকেনার প্রথাগত ধারণা। ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসে বাংলাদেশের এমএসএমই উদ্যোক্তাদের পণ্য বিপণনের এক চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
বৈশ্বিক মহামারি করোনার ফলে বিশ্ব অর্থনীতি পর্যুদস্ত। ভেঙে পড়েছে সাপ্লাই চেইন বা সরবরাহ ব্যবস্থা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার জোগান খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে। নামিদামি চেইন শপগুলোয় গিয়ে ক্রেতারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। কেউ কিনতে পেরেছেন, কেউ খালি হাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন। শিল্প-কারখানায় উৎপাদন থমকে গেছে, কর্ম হারিয়েছেন লাখো মানুষ।
এ ধরনের বৈশ্বিক পরিস্থিতির মাঝেও বাংলাদেশের সাপ্লাই চেইন অতটা নাজুক হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তা, প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত, শিল্প ও বাণিজ্যখাতের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি তুলনামূলক স্বাভাবিক রয়েছে। যতই দিন গড়াচ্ছে, করোনার নেতিবাচক প্রভাবের সাথে খাপ খেয়ে চলতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের জনগণের এ ধরনের অবিশ্বাস্য অভিযোজন ক্ষমতা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে।
বলতে দ্বিধা নেই, করোনা মহামারির শুরুতে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিপণন, যোগাযোগ, নাগরিক সেবা, সাপ্লাই চেইনসহ সামগ্রিক ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সৃজনশীল ও উদ্যোক্তাবান্ধব ‘একশপ’ উদ্যোগ অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। তাদের উৎপাদিত পণ্য বিপণনের সুযোগ তৈরি করেছে। ফলে তৃণমূল পর্যায়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল থেকেছে। জনগণ সহজেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা ক্রয় করতে পারছেন। গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতিময়তা অব্যাহত রয়েছে।
বর্তমানে দেশব্যাপী ৭ হাজার ৬০০টি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার গড়ে উঠেছে। এসব সেন্টারে ৩শ ধরনের সেবা দেওয়া হচ্ছে, ‘একশপ’ সেবা এর অন্যতম। সারাদেশে ডিজিটাল সেন্টার কেন্দ্রীক ১৫ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করছেন। এদের মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন। ‘একশপ’ উদ্যোগের মাধ্যমে তারা অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করেছেন।
এই ডিজিটাল বিপণন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত হয়েছেন ৭৪ লাখেরও বেশি মানুষ। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা ডিজিটাল সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনাবেচা করছেন। বর্তমানে ৬ হাজার ১৮৯ জন গ্রামীণ কারুশিল্পী একশপে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করছেন। ‘একশপ’ ইতোমধ্যে ৭৪ লাখের বেশি পণ্য ক্যাশ অন ডেলিভারির মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে।
দুই.
লকডাউনকালীন নাগরিকরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য এটুআই প্রকল্পের আওতায় চালু করা ‘৩৩৩-৫’ হেল্পলাইনে কল করেছিলেন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই হেল্পলাইনে ৬ লাখ ৬৫ হাজার গ্রাহক পণ্যের জন্য কল করেছেন। ফোন কল যাচাই-বাছাই করে একশপের মাধ্যমে ১ লাখ ২০ হাজার গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ই-কমার্স সেবার আওতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে একশপ একটি ব্যতিক্রমধর্মী ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। এ মার্কেট প্লেসের সাথে দেশের কমবেশি প্রায়সব ই-কমার্স প্লাটফর্ম যুক্ত রয়েছে। গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের তৈরি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, যেমন- লুঙ্গি, শাড়ি, ওষুধ, সালোয়ার-কামিজ, প্যান্ট-শার্ট, ঘড়ি, মোবাইল, টিভি, জুয়েলারি, পাঞ্জাবি, চারু-কারু পণ্য, বাঁশ-বেত থেকে তৈরি পণ্য, আর্টিফিশিয়াল জুয়েলারি, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, নকশি কাঁথা, শতরঞ্জি, কাঁসা-পিতলের তৈরি তৈজসপত্রসহ প্রায়সব পণ্য এখানে বেচাকেনা হচ্ছে। জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, শিক্ষার্থীদের বই থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় এমন কোনো পণ্য নেই, যা এ শপে কেনাবেচা হয় না।
এ বিপণন প্রক্রিয়ায় সহজেই গ্রামীণ এমএসএমই উদ্যোক্তারা নিজেদের পণ্যের তথ্য আপলোড করতে পারছেন। আবার বিভিন্ন ই-কমার্স কোম্পানির ক্রেতারা সেসব পণ্য কিনতে পারছেন। এতে একদিকে যেমন প্রান্তিক উৎপাদনকারীর পণ্য ই-কমার্স গ্রাহকের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে তেমনই শহরের মানুষও ঘরে বসে সরাসরি গ্রামের পণ্য কিনতে পারছেন। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎপাদনকারীরা একশপের মাধ্যমে বিদেশের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মেও পণ্য বাজারজাত করতে পারবেন। শিগগিরই মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে একশপের কার্যক্রম চালু হবে এবং ভবিষ্যতে ২৩টি দেশে এর সেবা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।
ই-মার্কেটিং প্ল্যাটফর্ম একশপের সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উদ্যোক্তাদের পণ্য বিপণন সহায়তা দিতে অনলাইন মার্কেটিং প্ল্যাটফর্ম তৈরির কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এ লক্ষ্যে পরামর্শক সংস্থা ড্রিম ৭১ বাংলাদেশ লিমিটেডের (Dream71 Bangladesh Ltd) সাথে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।
বিসিক অনলাইন মার্কেটিং প্ল্যাটফর্মে উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য বিপণনের জন্য সারাদেশে বিসিকের ৬৪টি জেলা অফিস ও ৭৬টি শিল্পনগরীতে ডিসপ্লে সেন্টার ও বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। ডিসপ্লে সেন্টার ও বিক্রয় কেন্দ্রগুলো স্থাপনে বিসিকের বিদ্যমান অবকাঠামোগত সুবিধা কাজে লাগানো হবে। বিসিক অনলাইন মার্কেটিং প্ল্যাটফর্মে সারাদেশের ক্ষুদ্র, কুটির, মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাগণ তাঁদের উৎপাদিত পণ্য বিপণনের সুযোগ পাবেন।
ই-কমার্স প্লাটফর্ম ‘একশপ’ চালুর পাশাপাশি অনলাইনে সরকারি সেবাপ্রাপ্তি, বিল পরিশোধ ও ডিজিটাল মিউনিসিপালিটি সার্ভিসেস সিস্টেম ‘একপে’ এবং ‘একসেবা’ চালু করা হয়েছে। ‘একপে’ একটি ঝামেলাহীন ‘ওয়ান-স্টপ পেমেন্ট’ প্লাটফর্ম। একপে ওয়েব সাইট বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে দেশের যেকোনো জায়গা থেকে যে কেউ তাদের ইউটিলিটি বিল দিতে পারছেন। যেকোনো সময় ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিং, ডিজিটাল ওয়ালেট, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, ব্যাংকের শাখা, ডিজিটাল সেন্টার বা যেকোনো এজেন্ট পয়েন্ট থেকে এ বিল পরিশোধ সম্ভব হচ্ছে। ফলে এখন আগের মত একেক প্রতিষ্ঠানের বিল দেওয়ার জন্য একেক পদ্ধতি বা ভিন্ন ভিন্ন ব্যাংকে ঘুরতে হয় না। নাগরিকরা নিজেদের সুবিধাজনক সময়ে ঘরে বসেই বিল পরিশোধ করতে পারছেন। দশটি আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে অংশীদারিত্বে একপে সেবা দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত ১৫ লাখের বেশি নাগরিক সব ধরনের পরিষেবা বিল, শিক্ষাসংক্রান্ত ফি, অন্যান্য ফি প্রদানের সহজ ও সমন্বিত পদ্ধতি হিসেবে এ সেবা পেয়েছেন।
সব সেবা একটি মাত্র প্লাটফর্মে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে ‘একসেবা’ চালু করা হয়েছে। অনলাইনে সেবার জন্য আবেদন দাখিল ও সেবা প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ডিজিটাল গভর্নেন্স প্রতিষ্ঠায় ‘একসেবা’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ পর্যন্ত ৮ হাজার ১৫১টির দফতরকে ‘একশপ’ সেবার সাথে যুক্ত করা হয়েছে এবং ৩৬৪টি সেবা সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে একসেবায় নিবন্ধিত ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭০ হাজারের বেশি। ইতোমধ্যে ১৪ হাজারের বেশি সেবার আবেদন এসেছে এবং ৫ হাজার ৭০৯টি আবেদন নিষ্পন্ন হয়েছে। এ কার্যক্রম চালু হওয়ায় পৌর এলাকার নাগরিকরা অনলাইনে মিউনিসিপালিটি বা সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন সেবা পাওয়ার পাশাপাশি হোল্ডিং ট্যাক্স ও বিভিন্ন সরকারি সেবার বিল দিতে পারছেন।
তিন.
গত ক’বছরে বাংলাদেশ ডিজিটাল গভর্নেন্স ইনডেক্সে ৪০-৫০ ধাপ এগিয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে আরও ৫০ ধাপ এগিয়ে যাওয়ার অভীষ্ট লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। এসময়ের মধ্যে জাতিসংঘের আইসিটি ইন্ডিকেটর ডিজিটাল গভর্নেন্স ইনডেক্সের সেরা ৫০ এর মধ্যে স্থান করে নেওয়াই আমাদের লক্ষ্য। নাগরিক সেবার প্রায় সবগুলো জনগণের আঙুলের ছোঁয়ায় আনতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (কোইকা) সহযোগিতায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ ‘ই-গভর্নমেন্ট মাস্টারপ্ল্যান’ প্রণয়ন করেছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের রোডম্যাপ ধরে বাংলাদেশে দ্রুত সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্নকে একসময় অলীক কল্পনা মনে হলেও আজ এটি প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা। সেদিন আর বেশি দূরে নয়; যেদিন বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশ পরিচিত হবে একটি প্রযুক্তিদক্ষ, শিল্পসমৃদ্ধ ও জ্ঞাননির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে।