একদিকে দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাড়ছে প্রতিদিন, অন্যদিকে এগিয়ে আসছে ঈদুল আজহা। কোরবানির পশুর হাট নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে এসেছে এই মধ্যে। হাটগুলো কবে বসবে, এর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, লকডাউন থাকবে কি না, না থাকলে আগ্রহীরা হাটে বেচা-কেনায় অংশ নিতে পারবেন কতোটুকু, এমনকি হাটে যথেষ্ট কোরবানির পশু থাকবে কি না এমন নানা রকম প্রশ্ন ভাবাচ্ছে ক্রেতাদের।
এমন পরিস্থিতির সম্ভাব্য সহজ সমাধান হিসেবে কেউ কেউ বিবেচনা করছেন অনলাইনের হাট বাজার। সোশাল মিডিয়া, বিভিন্ন ই-কমার্স সাইট আর সরকারি উদ্যোগের কারণে আগ্রহী ক্রেতাদের হাতে অনলাইনে বিকল্পও আছে বেশ কিছু।
কোরবানির গরুর জন্য বিভিন্ন ই-কমার্স সাইট যথেষ্টই ক্রেতাবান্ধব। তবে, আসলেই কি ক্রেতারা আগ্রহী হচ্ছেন অনলাইনে কোরবানির পশু কেনায়?
দারাজ
অন্যদিকে ই-কমার্স সাইট দারাজ-এর অ্যাপে চালু হয়েছে নতুন ‘কোরবানির হাট’ শ্রেণি। ডিজিটাল হাট এবং বেঙ্গল মিটের মতো দারাজেও বেশিরভাগ পশুর আনুমানিক ‘লাইভ ওয়েইট (জ্যান্ত অবস্থায় পশুর ওজন)’ উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে। তবে ডিজিটাল হাটের মতো দারাজের ক্ষেত্রেও পশুর দাম ও উল্লেখিত আনুমানিক ওজনের সামঞ্জস্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন ক্রেতাদের অনেকে। বলে রাখা ভালো, উপরে উল্লেখিত সবগুলো সাইট/অ্যাপেই পশুর একদাম নির্ধারণ করে দিচ্ছেন বিক্রেতারা। ডিজিটাল হাট আর দারাজে বিক্রেতার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের তথ্য দেওয়া আছে বেশিরভাগ পোস্টে।
ডিজিটাল হাট
৪ জুলাই থেকে বাংলাদেশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হয়েছে কোরবানির পশুর ডিজিটাল হাট। ৩০ জুন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ডিজিটাল হাট-এর গাউডলাইনে ক্রেতা যেন তার পছন্দের একটি ত্রুটিহীন কোরবানির পশু সময় মতো হাতে পান সে বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করার হয়েছে বিভিন্নভাবে।
ওয়েবসাইটটিতে কোরবানির পশুগুলোকে ভাগ করা আছে ছয়টি শ্রেণিতে। আছে সার্চ ফিল্টার ব্যবহার করে পছন্দের ক্রয়সীমার মধ্যে পশু খোঁজার সুযোগ। এ ছাড়াও ক্রেতা ওয়েবসাইটে তালিকাভূক্ত ঢাকার আটটি হাট থেকে নিজের পছন্দ মতো ‘লোকেশন’ বেছে নিয়ে কোরবানির পশু খুঁজতে পারবেন। ডিজিটাল হাটে কোরবানির পশুর জন্য হাসিল বা কর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, পশু ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব বিক্রেতার। পাশাপাশি স্লটারিং সেবারও ব্যবস্থা রাখা হয়েছিলো, যদিও স্লটারিং সেবার জন্য ক্রেতাকে বুকিং দিতে হবে ১০ জুলাইয়ের মধ্যে।
এসবের পাশাপাশি খামারগুলোর আলাদা তালিকা রয়েছে সাইটটিতে। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত নির্দেশিকায় স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, ডিজিটাল হাটে পশু বিক্রয়ের জন্য আবেদনকারীকে অবশ্যই ই-কমার্স এসোসিয়েশন বা বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম এসোসিয়েশন (বিডিএফএ) অথবা জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন হাট এর সদস্য হতে হবে। এ ছাড়াও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বিক্রেতার ট্রেড লাইসেন্স এবং নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। স্লটারিং সেবার দায়িত্বেও আছে বিডিএফএ।
এই সংগঠন সদস্য বিষয়ক নিয়মের কারণে অন্যান্য বছর যেমন নিজ বাড়িতে একটা দুটা গরু সারা বছর খাইয়ে তৈরি করে গেরস্থ লোকজন হাটে নিয়ে আসতেন, তারা এই ডিজটাল হাটগুলোর বাইরেই থেকে যাচ্ছেন।
বেঙ্গল মিট
সরকারি উদ্যোগের বাইরেও অনলাইনে বিভিন্ন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে কোরবানির পশু বিক্রি করছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও খামারিরা। বেঙ্গল মিটের ওয়েবসাইটটিতে প্রক্রিয়াজাত মাংসের পাশাপাশি ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে নতুন পেইজে কোরবানির পশুর তালিকা দেওয়া হয়েছে। সাইটে ক্রেতা তার ক্রয়সীমা, ওজন, এমনকি পশুর গায়ের রং বিবেচনা করে কোরবানির পশু কিনতে পারবেন। তবে অনলাইনের অন্যান্য বিক্রেতার সঙ্গে বেঙ্গল মিটের একটি পার্থক্য লক্ষণীয়, প্রতিটি পশুর বিক্রয় পোষ্টে পশুটি রোগবালাই মুক্ত রাখতে কোন কোন টিকা দেওয়া হয়েছে সেটি উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে।
খামারের ফেসবুকভিত্তিক বিক্রি
কোরবানির পশু বিক্রির একটি বড় প্লাটফর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে সোশাল মিডিয়া সাইট ফেইসবুক। ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলার খামারীরা নিজেদের পশুর প্রচারণা ও বিক্রির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন সোশাল মিডিয়া সাইটটি। আর সোশাল মিডিয়ায় বিক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ তুলনামূলক সহজ হওয়ায়, ক্রেতাদের আগ্রহ, প্রশ্ন এবং দ্ধিধার বিষয়গুলো নজরে আসে সহজে।
ফেইসবুকের বেশ কয়েকটি অ্যাগ্রো-ফার্মের পেইজে কোরবানির পশু নিয়ে ক্রেতাদের কৌতুহল ছিলো লক্ষণীয়। সাদেক এগ্রো, মেঘডুবি এগ্রো, এসএসি এগ্রো ও আরকে এগ্রো ফার্ম-এর মতো বেশ কয়েকটি ফার্মের ফেইসবুক পেইজের তথ্য অনুযায়ী, জুন মাস থেকেই কোরবানির পশুর প্রি-বুকিং চলছে। তবে বেশিরভাগ ক্রেতা কোরবানির পশু কিনছেন সরাসরি খামারে গিয়ে। খামারগুলিও ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে খামারে আসার জন্য। যদিও করোনা পরিস্থিতিতে সেই কাজটিও বেশ জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দাম নিয়ে কমেন্ট সেকশনে আগ্রহী ক্রেতাদের প্রশ্ন থাকলেও “ইনবক্সে” বা সরাসরি আলাপচারিতার আগ্রহ দেখিয়েছে অনেক খামার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোরবানির পশুর আনুমানিক ওজন উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে পোস্টগুলোতে। এ ছাড়াও ঈদের আগ পর্যন্ত পশু খামারে রেখেই দেখাশোনা, এবং কোরবানির আগে হোম ডেলিভারির সেবাও দিচ্ছে অনেকগুলো খামার।
তবে, একেবারে ভিন্ন একটি অনিশ্চয়তার কথা বললেন বিপণন পেশাজীবী মাসুদ হাসান। অনলাইনে দুই-চার হাজার টাকার পণ্য মাঝেমধ্যেই কেনা হয়। কিন্তু সেই তুলনায় কোরবানির গরুর মূল্য অনেক বেশি। এতো টাকার গরু কাছ থেকে না দেখে কেনা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন তিনি।
“কেবল টাকা নয়। এটা তো ধর্মীয় বিষয়ও। টাকা খোয়া যাওয়ার পাশাপাশি কোরবানি দিতে না পরার ভয়টি ছিল আরো বেশি।”
এই সমস্যার সমাধান আগের বছর করেছেন মাসুদ। “আমার পরিচিত এক উদ্যোক্তার খামারের ফেসবুক পেইজ থেকে গরু কিনি আমি।”
এ বছর আর পরিচিত খামারী খুঁজতে যাননি এই ক্রেতা। ভিন্ন এবং প্রায় অপরিচিত একটি খামার থেকে পশু বাছাই করেছেন তিনি। কারণ হিসেবে, ওজনের তুলনায় মূল্য, স্লটার সেবার মতো বিষয়গুলো মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
কিন্তু অর্থের নিরাপত্তা?
মাসুদ বললেন, “গতবারই আস্থা কিছুটা তৈরি হয়েছিল। এবার যখন দেখলাম যে অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়েতে প্রাপকের অ্যাকাউন্ট নাম্বার প্রবেশ করানোর সঙ্গে সঙ্গে পর্দায় খামারের নামটিই দেখালো, আমি নিশ্চিত হলাম যে অ্যাকাউন্ট প্রতিষ্ঠানের এবং আমার হাতে লেনদেনের প্রিন্টেড রশিদ আছে। অন্তত আইনগত দিক থেকে কিছুটা ভরসা পাওয়া যায়।”
সরকারি দপ্তর, সংগঠনের নজরদারি, ব্যবসার স্বার্থেই ক্রেতাবান্ধব হওয়ার চেষ্টাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে আশা করা যায় সবকিছু নিয়মাফিকই চলবে। তবে, নিজে হাটে গিয়ে পশু বাছাই, দরদাম করা, বাড়িতে নিয়ে আসার মতো কাজগলো অনেক ক্রেতাই অসম্ভব উৎসাহ নিয়ে করে এসেছেন আগের বছরগুলোতে। এবার করোনার বিস্তারে সেটি বাদ দিতেই হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যের বিবেচনায় এইটুকু মেনে না নিয়ে সম্ভবত উপায়ও নেই।