২০২১ সালে আর্থিক খাতে সবচেয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে অনলাইনভিত্তিক কেনাকাটার মাধ্যম ই-কমার্স। ডেসিটিনির মতো প্রতারণার জাল ফেলে গ্রাহকের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচারের অভিযোগ উঠে ই-ভ্যালি, ধামাকা, ই-অরেঞ্জসহ ডজনখানেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। যদিও গ্রাহকদের আন্দোলন ও মামলার মুখে গ্রেপ্তার হয়েছেন বেশ কয়েকজন প্রতারক।
প্রায় অর্ধেক দামে মিলবে লাখ টাকার মোটরবাইক, এসি, ফ্রিজ টেলিভিশন, হাজার টাকার নিত্যপণ্যের কেনাকাটাও করা যাবে নামমাত্র মূল্যে। তবে এসব অফারের সুবিধা মিলবে পণ্যের আগাম দাম পরিশোধে।
এমএলএম প্রতিষ্ঠান ডেসটিনির বিজনেস মডেলে ২০২১ এর শুরু দিকে অনলাইনে ব্যাপক প্রচারের পাশাপাশি জাতীয় ক্রিকেট দলের স্পন্সর হয়ে ই-ভ্যালি এমন ব্যবসার সূচনা করে।
এদিকে, ক্রিকেটার মাশরাফী বিন মোর্ত্তজাকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করে টেলিভিশনসহ নানান মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণ মানুষের নজর কাড়ে আরেক প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ। পিছিয়ে ছিল না ধামাকা, কিউ-কম, আলেশা মার্টের মতো ডজনের বেশি প্রতিষ্ঠান।
জনপ্রিয় ব্যক্তিদের ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন এবং শুরুর দিকে গ্রাহকের অর্ডার করা বাইকসহ কিছু পণ্য বুঝিয়ে দিয়ে আস্থা অর্জন করে এসব প্রতিষ্ঠান। আর এমন লোভের ফাঁদে পড়ে পণ্য কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে লাখ লাখ গ্রাহক। কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেন অনেকে।
বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশ পেতে শুরু করে ই-ভ্যালি, ধামাক, ই-অরেঞ্জের প্রতারণার খরব। নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। গ্রাহকের হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে অফিস বন্ধ করে দেয় এসব প্রতিষ্ঠান। কয়েক হাজার কোটি টাকা আটকে থাকে পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানেও।
টাকা পরিশোধের পর পণ্য না পেয়ে গেল সেপ্টেম্বরে আন্দোলনে নামে ভুক্তভোগীরা। ঘেরাও করা হয় মাশরাফীর গুলশানের বাড়ি। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মামলা করা হয় প্রতারক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে।
একপর্যায়ে ধরা পড়েন ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, কিউকম ধামাকার মালিকরা। কারাগারে দিন কাটছে এসব প্রতারকের। আর প্রতারিত-ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা রয়েছেন টাকা ফেরত না পাওয়ায় আশঙ্কায়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ
অনলাইন ব্যবসায় শৃঙ্খলা ফেরাতে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন (ইউবিআইডি) নেওয়া বাধ্যতামূলক করছে সরকার। আগামী বছর ইউবিআইডি ছাড়া ই-কমার্স ব্যবসা করার আর কোনো সুযোগ থাকছে না। এটি চালু হওয়ার পর রেজিস্ট্রেশনবিহীন কোনো কোম্পানি দেশে অনলাইনে কোনো ধরনের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবে না। বিটিআরসির সহায়তায় রেজিস্ট্রেশনবিহীন কোম্পানিগুলোর ব্যবসা বন্ধ করে দেবে সরকার।
ই-কমার্স খাত নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরটির কার্যক্রম জেলা থেকে বাড়িয়ে উপজেলা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ই-কমার্স নজরদারিতে নতুন অ্যাপও আনছে।
এছাড়া ই-কমার্সে আটকে থাকা টাকা ফেরতের উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে পেমেন্ট গেটওয়েগুলোয় আটকে থাকা ২১৪ কোটি টাকা গ্রাহকদের হিসাবে ফেরত দিতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি পাঠায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
চিঠিতে বলা হয়, যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো মামলা চলমান নেই, সেসব প্রতিষ্ঠানের নামে এসক্রো সার্ভিসে ভোক্তাদের আটকে থাকা অর্থ ফেরত দেওয়া হবে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পেমেন্ট গেটওয়েগুলোকে অর্থ ছাড়ের নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়।
ই-কমার্স খাতের কারিগরি কমিটির সমন্বয়ক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলছেন, গত ৩০ জুনের পরে ই-কমার্স পেমেন্ট গেটওয়েতে যে টাকাগুলো আটকে ছিল, সেগুলো ফেরত দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংও নিয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাদের পেমেন্ট গেটওয়েকে ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
ই-কমার্স: চমকে শুরু হতাশায় শেষ
করোনা মহামারির শুরুতে ঘরবন্দি গ্রাহকের দোরগোড়ায় নিরবচ্ছিন্ন পণ্য পৌঁছে প্রশংসা আর মুনাফায় ভাসতে থাকে দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। সে সময় ৩শ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধির দাবি করেছিলেন খাত সংশ্লিষ্টরা। ২০২১ সালের শুরুতে রীতিমতো জোয়ার চলছিল ই-কমার্সে। তবে বছরের মাঝামাঝিতেই সামনে আসতে থাকে সমস্যা। আশার জোয়ারে আসে ভাটা।
বছরের শেষে এসে পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে আশা জাগানিয়া খাতটি। সবচেয়ে চমক জাগানো ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালি এবং একই মডেলের প্রতিষ্ঠানের মালিক, সিইওরা এখন প্রতারণার মামলায় জেলে। আর বিপুল পরিমাণ অর্থ হারানো গ্রাহক-বিনিয়োগকারীরা অর্থ উদ্ধারে ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে।