গোটা অর্থনীতিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে ই-কমার্স, আজ এ কথা বলা যায় অনায়াসেই। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজার হাজার মানুষের। নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এই সেক্টরে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়। প্রতি বছরেই বাড়ছে উদ্যোক্তা, বাড়ছে কর্মসংস্থান। অনলাইনের প্রচার ও প্রসার যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে ব্যবসার সুযোগ। তবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার কারণে তার দায়ভার সব ই-কমার্স খাতে পড়ছে।
ই-কমার্সের বদৌলতে পণ্যের বাজার এখন অনেক বেশি বিস্তৃত, অনেক প্রসারিত। কোনো কারণে যদি পণ্যের বাজার বড় হয় তাহলে সেই বাজারে নতুন নতুন উদ্যোক্তার আগমন ঘটবে, এটাই স্বাভাবিক। একদিকে বৃহৎ আকারের বাজার অন্যদিকে বিপুল সংখ্যক বিক্রেতার সমাগমের ফলে বাজারের আয়তন প্রতিনিয়ত প্রসারিত হবে, এটাই স্বাভাবিক।
ই-কমার্স বছরের ৩৬৫ দিন আর দিনের ২৪ ঘণ্টাই খোলা। যে কারণে ক্রেতারা এই সুযোগটি পুরোপুরি গ্রহণের ব্যাপারে তুমুলভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ই-কমার্স একটি স্মার্ট ব্যবসা সন্দেহ নেই। এখানে উন্নত গ্রাহক সেবা, গ্রাহকসন্তুষ্টি সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকলে ব্যবসায় সফলতা পাওয়া সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে অনেকে ই-কমার্স ব্যবসায় জড়িত হলেও অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারছে না। অনেকেই বুঝে না বুঝেই এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। কারণ, ব্যবসা ভালোভাবে না বুঝে শুরু করলে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে না বা টিকে থাকতে পারে না। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এক কথায় বলা যায়, কেবল যোগ্যরাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে। ই-কমার্সের বিস্তৃতির জন্য সরকারকে আরো সচেষ্ট হতে হবে। কারণ, সরকারিভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য আর্থিক লেনদেনে ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারকে উত্সাহিত করা হচ্ছে।
ই-কমার্স খাতের জন্য করোনা মহামারি একটা বড় সুযোগ হিসেবে হাজির হয়। কিন্তু অতিলোভ ও নীতির অভাবে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা যায়নি। ই-কমার্স ও এ খাতের উদ্যোক্তাদের এখন নানা সমালোচনার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। অনলাইনে পণ্য বিক্রির পদ্ধতি ও ধরন নিয়ে যে সমালোচনা চলছে, তা এক সময়ের আলোচিত এমএলএম কেলেঙ্কারির কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। বড় অঙ্কের ক্যাশব্যাক, অফারের নামে ক্রেতাকে সময়মতো পণ্য না দেওয়া ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের অর্থ না দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি। ইভ্যালি পুরো ই-কমার্স খাতকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। শুধু ইভ্যালিই নয়, অন্তত ২০টি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের সঙ্গে বড় ধরনের প্রতারণা করেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের অর্থ ফেরতের চেক দিয়েছে। কিন্তু ব্যাংক হিসাবে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় চেক ‘বাউন্স’ হচ্ছে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে একে একে সম্পর্ক ছিন্ন করছে পণ্য সরবরাহকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
ই-কমার্সের নামে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যতে যাতে কোনো ধরনের অনিয়ম করতে না পারে, সেদিকে নজর বাড়ানো হবে। নিয়ম-নীতি ও দেশের প্রচলিত আইনের মধ্য দিয়ে বাড়ানো হবে ই-কমার্স খাতের সম্প্রসারণ। গ্রাহক প্রতারিত হতে পারেন—এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান আর ই-কমার্সের নিবন্ধন পাবে না। বর্তমানে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সদস্য দেড় হাজারের বেশি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের তালিকায়ও আছে এক হাজার প্রতিষ্ঠানের নাম।
গবেষণা সংস্থা লাইটক্যাসল পার্টনার্সের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ই-কমার্সের বাজার দাঁড়াবে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো। অথচ ৫ বছর আগেও, অর্থাৎ ২০১৬ সালে দেশে এ খাতের বাজার ছিল ৫৬০ কোটি টাকার। এ খাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫০ হাজারের বেশি। গত কয়েক বছরে সব মিলিয়ে ই-কমার্স খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষের। বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণামূলক আচরণের এজন্য এ খাত বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব দেশের অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রেও পড়বে। এই অবস্থায় বিদ্যমান আইন ও বিধিবিধান সংশোধন করা এবং প্রতারক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
ই-কমার্স খাতে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে ডিজিটাল বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নম্বর (ডিবিআইডি) চালু করা হয়েছে। এর ফলে সহজে নজরদারির মধ্যে আসবে বহুল বিতর্কিত এই খাত। ই-কমার্স খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এজন্য যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর থেকে একটি নিবন্ধন নিতে হবে এ খাতের উদ্যোক্তাদের। যে কোনো সময় যে কোনো উদ্যোক্তা ব্যবসা পরিচালনার জন্য এ প্রক্রিয়ার মধ্যে সংযুক্ত হতে পারবেন। এটা আপাতত ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে যারা ব্যবসা করতেন তাদের এক ধরনের স্বীকৃতি হিসেবে এই সনদ দেওয়া হচ্ছে।
এই সনদ দিতে গিয়ে হয়তো অনেক ভুলত্রুটি দেখা দেবে। ধীরে ধীরে আমাদের সেগুলোর সমাধান করতে হবে। এটা পাইলটিং ভিত্তিতে শুরু হয়েছে। যারা এই নিবন্ধনের আওতায় আসবে না, ভবিষ্যতে সরকার তাদের দায়দায়িত্ব নেবে না। ডিবিআইডি দিয়ে শুরুর পর পর্যায়ক্রমে ই-কমার্স খাতের জন্য আরো বিভিন্ন পদ্ধতি চালু করা হবে।
ই-ক্যাবের তালিকাভুক্ত ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১ হাজার ৬০৯টি। ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করা গেলে ই-কমার্স ব্যবসায় প্রতারণা দূর হবে। ভোক্তারা সুরক্ষিত হবে, প্রতারণায় জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করা যাবে এবং বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।