যে কোনো উদ্যোগ বা বিজনেসের মূল ভিত্তি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল কাস্টমার। একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির সম্ভাব্য কাস্টমারদের নির্দিষ্ট চাহিদা মেটানোর কথা চিন্তা করে এবং তাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতেই যাত্রা শুরু করে একেকটা উদ্যোগ। তাই প্রতিটি উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্যই হওয়া উচিত, সেরা প্রোডাক্ট এবং সার্ভিস দেয়ার মাধ্যমে কাস্টমারদের সন্তুষ্টি অর্জন করা। কাস্টমার সন্তুষ্টির উপরই উদ্যোগের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে।
বর্তমানে দেশীয় পণ্যের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি দ্রুত বেড়ে উঠছে, তাই এর স্থিরতা আনার জন্য এবং এর গ্রোথ দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য সচেতন হওয়ার সময় এখনই। আমাদের দেশের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে মানুষের মনে এখন অনেক বিতর্ক আর দ্বিধা কাজ করলেও এর আঁচ যেন দেশীয় পণ্যের ইন্ডাস্ট্রির উপর না পরে সেজন্যই এই ইন্ডাস্টির উদ্যোক্তাদেরকে আরও সতর্ক হতে হবে, নিজেদের সুনাম ধরে রাখার জন্য চেষ্টা করতে হবে। আর এই চেষ্টার প্রথম এবং মূল ফোকাসই হওয়া উচিত কাস্টমার কেন্দ্রিক। কাস্টমারদেরকে সন্তুষ্ট রাখাই হবে প্রতিটি উদ্যোক্তার প্রধান লক্ষ্য।
আমাদের দেশের অনলাইন ভিত্তিক ই-কমার্স বিজনেস এখনো অনেকটাই ফেইসবুক নির্ভর আর এর মূল দুইটি উপাদান হল- ফেইসবুক পেইজ আর গ্রুপ। যদিও দেশীয় পণ্যের বাজার বড় হচ্ছে, তারপরও এখনো দেশীয় পণ্যের উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগেরই পেইজ, গ্রুপ খুব বেশি বড় নয়। পেইজে খুব বেশি ফলোয়ার নেই, নিয়মিত ভিজিটর নেই। পেইজের পোস্টগুলো তাই আশানুরূপ রীচ হয় না, লাইক-কমেন্ট প্রায় আসে না এবং পার্সোনাল বিজনেস গ্রুপগুলোতেও এক্টিভ মেম্বার সংখ্যা নগণ্য বলা যায়।
আবার দেশীয় পণ্যের বড় যে কমিউনিটি বা ফেইসবুক গ্রুপ রয়েছে, সেগুলোতেও প্রতিযোগীতা অনেক বেশি। কারণ প্রায় একই ধরণের প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করছে সবাই এবং নিয়মিত সেগুলোকে প্রেজেন্ট করছে। তাই নিজেকে এবং নিজের উদ্যোগকে বাকি সবার থেকে আলাদা করে তুলে না ধরতে পারলে ভালো করার সুযোগ থাকে না। এই ব্যপারগুলো বেশ চ্যালেঞ্জিং উদ্যোক্তাদের জন্য। আর এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য সমাধান একটাই কাস্টমারদের কাছে নিজেকে আলাদা করে প্রেজেন্ট করা, যা কাস্টমারদের সাহায্য করবে অনেকের মাঝে আপনাকে খুঁজে নেয়ার জন্য। দেশীয় পণ্যের উদ্যোক্তাদের তাই কাস্টমার সার্ভিস এবং সন্তুষ্টির দিকে মনযোগ দেয়া সবচেয়ে জরুরী।
যা করণীয় এবং বর্জনীয়ঃ
- কাস্টমারদের খুশি করতে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী উপায় হল ডেলিভারি চার্জ ফ্রি করে দেয়া। এটি কাস্টমারদের প্রতি উদ্যোক্তার সম্মান প্রকাশ করে এবং কাস্টমাররাও ডেলিভারি চার্জের বাড়তি বোঝা থেকে মুক্তি পেয়ে খুব খুশি হয়ে যায়। প্রোডাক্টে ডিস্কাউন্ট অফার দেয়ার থেকে ডেলিভারি চার্জ ফ্রি দেয়া অনেক বেশি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে কাস্টমারের মনে। কারণ অনেকের একটা ধারণা যে, সমস্যাযুক্ত পণ্যেই হয়ত ডিস্কাউন্ট দেয়া হয়। এই ধারণা সবক্ষেত্রে সত্য না হলেও ডিস্কাউন্ট অফারের এই নেতিবাচক ধারণার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে ডেলিভারি চার্জ কাস্টমারদের সম্মানে ফ্রি করে দেয়াই তাই তাদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে অধিক ভূমিকা রাখতে পারে। যা না বললেই নয়, তা হল- ডেলিভারি চার্জ অবশ্যই উদ্যোক্তারা নিজের লস করে ফ্রি দিবে না, প্রাইসিংটা এভাবেই করতে হবে যেন উভয়পক্ষই এতে লাভবান হয়, সন্তুষ্ট থাকে।
- ক্রেতারা চায় আন্তরিকতা। অনলাইনে প্রোডাক্ট সরাসরি দেখে নেয়ার সুযোগ নেই, এর জন্য একটা আস্থা বিশ্বাসের ঘাটতি থেকেই যায়, আর দুশ্চিন্তা হয়, ওই পাশের মানুষটা কতটা ভালো পণ্য দিবে তা নিয়ে। সেই দুশ্চিন্তা থেকেই অনেক প্রশ্ন করে তারা, অনেকে ক্রেতাদের প্রশ্নে বিরক্তি প্রকাশ করে যা অবশ্যই করা যাবে না। বরং উদ্যোক্তাদেরকে ক্রেতা সাইকোলজি বুঝেই সার্ভিস দিতে হবে, খুব আন্তরিকভাবে সময় নিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে যেন, দূরত্বের এই ব্যবধান দূর করে ক্রেতার মনে আস্থার জায়গা তৈরী করে নিতে সক্ষম হয়।
- প্রোডাক্টের রিটার্ন পলিসি রাখতে হবে। যেহেতু পণ্য সরাসরি দেখে নেয়ার সুযোগ নেই কাস্টমারের, শুধু ছবিই ভরসা। এমনও হতে পারে যে, প্রোডাক্ট নিয়ে সরাসরি দেখার পর সেটা ভালো লাগছে না, ছবির সাথে রিয়েল কালারে পার্থক্য রয়েছে বা প্রোডাক্টে কোনো সমস্যা বের হয়েছে, এক্ষেত্রে যেন কাস্টমাররা চাইলে প্রোডাক্ট ফেরত দিতে পারে এই সুযোগটা রাখতে হবে। এটা কাস্টমারদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরীতে, আস্থা বাড়াতে অনেক বেশি সাহায্য করে। তবে অবশ্যই পচনশীল দ্রব্য যেমন- হোমমেইড খাবারের ক্ষেত্রে এই পলিসি গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই খাবারের উদ্যোক্তাদের অবশ্যই নিজেদের পেইজে বা গ্রুপে এটা নিয়ে ডিটেইলস লিখে দিতে হবে, কেন তারা রিটার্ন পলিসি রাখতে পারছেন না এবং তাদের থেকে তাই যেন কাস্টমার খাবার জেনে বুঝেই অর্ডার করেন।
- যেহেতু দেশীয় পণ্যের উদ্যোক্তাদের মূল সম্পদই হল কাস্টমারদের সন্তুষ্টি, তাই এই ইন্ডাস্টিতে কাস্টমার রিভিউ খুব বেশিই গুরুত্বপুর্ণ। কাস্টমারদের পজিটিভ রিভিউ উদ্যোগের ভ্যালু বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়, এটা ক্রেতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে, লং রানে টিকে থাকতে সাহায্য করে। তাই উদ্যোক্তাদেরকে এমনভাবেই কাস্টমারদের মন জয় করতে হবে, তাদের মাথায় গেঁথে যেতে হবে যে, কাস্টমাররা খুশি হয়েই তাদের প্রোফাইলে, পেইজে এবং গ্রুপে রিভিউ দিবেন নিজে থেকেই।
- কাস্টমার রা অনেক কথাই বলতে পারেন, অনেক নেগেটিভিটি তাদের কথায় প্রকাশ পেতে পারে। প্রাইস, কোয়ালিটি নিয়ে অনেক মন্তব্যই হয়ত তারা করে ফেলেন, যা উদ্যোক্তাদের মন খারাপ করে দেয়। কিন্তু কাস্টমার যাই বলুক না কেনো সেটার বিপরীতে নেগেটিভ রিএক্ট করা যাবে না। কাস্টমারদের কথা নিয়ে ব্যঙ্গ করে, তাদের খোঁচা দিয়ে ওপেন পোস্ট করা যাবে না। বরং ঠান্ডা মাথায় ধৈর্য ধরে, ভদ্র ভাষায়, মিষ্টি করে তাদেরকে বুঝিয়ে সব বলতে হবে। তবে এমনিতেই কাস্টমারদের মনে পজিটিভ ধারণা তৈরী হবে ওই উদ্যোক্তার প্রতি এবং আগ্রহী হবে তার ক্রেতা হওয়ার জন্য।
ভালো মানের কাস্টমার সার্ভিস দেয়া শুধু ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের জন্যই না, বড় কোম্পানিগুলোর জন্যও এটি অনুসরণীয়। এটিকে যারা অবহেলা করবে তারা স্বল্প মেয়াদে টিকে গেলেও দীর্ঘ মেয়াদে কোনোভাবেই টিকবে না। আর “Customer is always right”, “Customer is King” এসব কথা আমরা বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং বইতে দেখতে পাই। অনেক সময় কাস্টমারদের সাথে হয়ত অনেক কিছুই বনবে না এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই কাস্টমারদের দোষ থাকতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে যতটা সম্ভব নমনীয় হয়ে তাদের সাথে বিনয়ী আচরণ করলে অনেক সুফল পাওয়া যায়।
যেটা সব উদ্যোক্তার করা উচিত, তা হচ্ছে যে, ৫% পণ্য রিটার্ণ আসবে বা কাস্টমার খুশি হবে না বা ফেরত দিবে এবং সেটি বাকি পণ্যগুলোর দামে এমনভাবে সমন্বয় করে প্রাইসিং করতে হবে যাতে করে কোনো লস হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।
এই সামান্য কিছু বিষয় মাথায় রাখতে পারলে কাস্টমার সার্ভিসের মাধ্যমে বর্তমানে এবং ভবিষ্যতের সব কাস্টমারদেরকে সন্তুষ্ট করা যাবে এবং এর ফলে বিক্রিও অনেক বাড়বে। বিক্রি বাড়ার পাশাপাশি রিপিট কাস্টমার, রেফারেল কাস্টমার এদের সংখ্যাও বাড়বে। আর কাস্টমার সার্ভিস যদি ভালো হয়, তাহলে যা বেশি লাভ হয় তা হচ্ছে,, অনলাইনে রিভিউ পাবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
ধরা যাক, দুটি পেইজের বিক্রি প্রায় কাছাকাছি, কিন্তু একটি পেইজে কাস্টমার সার্ভিস যথেষ্ট ভালো, আর অন্য পেইজের সার্ভিস তত ভালো নয়। তাহলে কাস্টমার সার্ভিস যাদের ভালো, তাদের রিভিউ পোস্ট অন্য পেইজটির তুলনায় অন্তত ২-৩ গুন বেশি আসবে। এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদে তারা অনেক বেশি এগিয়ে যাবে।
অনেক উদ্যোক্তা কাস্টমার সার্ভিসকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না, তারা ভুলে যান যে, নতুন কাস্টমার পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। মার্কেটিং এর পেছনে বাজেট না থাকলে কাস্টমার সহজে পাওয়া যায় না। আর যদি পুরাতন কাস্টমারদের ধরে রাখতে হয় তাহলে অবশ্যই উন্নত মানের সেবা প্রদান করতেই হবে এবং এই সামান্য ব্যপারটি যেসব উদ্যোক্তারা ভালো বুঝতে পারবেন তাদের জন্য অনেক বেশি উপকার হবে।
কাস্টমার সার্ভিস শুধু বিক্রির সাথে সম্পর্কিত নয়, এটি উদ্যোগ বা কোম্পানির সুনাম এবং ব্র্যান্ড ইমেজের সাথেও জড়িত। আপনি যদি ভালো মানের সেবা দিতে পারেন, তাহলে আপনার কোম্পানির সুনাম বাড়বে। আর যদি কাস্টমার রা সন্তুষ্ট না হয়, তাহলে এর সুনাম কমবে। আরেকটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে যে, বর্তমান যুগ হচ্ছে ইন্টারনেটের যুগ, সোসাল মিডিয়ার যুগ এবং যে কেউ আপনার প্রোডাক্ট পেয়ে খুশি হলেই সাথে সাথে একটা ছবি তুলে তা নিয়ে পোস্ট দিতে পারে, আবার কেউ যদি অসন্তুষ্ট হয় তাহলে সেই প্রোডাক্ট নিয়ে কেন সন্তুষ্ট নয় সেটা নিয়েও বলতে পারেন। তাই আপনার এই বিষয়টি চিন্তা করতে হবে। একটি পজিটিভ রিভিউ যেমন আপনার জন্য উপকারী, তেমনি একটি নেগেটিভ পোস্ট আপনার জন্য ক্ষতিকর। তাছাড়া গুগল এবং ফেইসবুকে আপনার প্রতিষ্ঠান বা পেইজের নাম দিয়ে সার্চ করলে যে রেজাল্ট নিয়ে আসে, অনেক কাস্টমার সেই রিভিউগুলো বা পোস্টগুলো পড়ে কেনা বা না কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। আর এই সবই কাস্টমার সার্ভিসের উপর অনেকাংশে নির্ভর করে।
কাস্টমার সার্ভিস ভালো করতে পারলে ভালো যে দিকটা হয় তা হচ্ছে, তারা আপনার পেইজ ছেড়ে অন্যদিকে যাবে না। ধরেন আপনি, টাঙ্গাইলের কটকি শাড়ি বিক্রি করেন এবং ফেইসবুকে আরও অন্তত ১০০ পেইজে এই শাড়িগুলো পাওয়া যায়, কিন্তু আপনার কাস্টমার সার্ভিস যদি ভালো হয় তাহলে আপনার যারা কাস্টমার তারা আপনার প্রতি অনুরক্ত থাকবে এবং সহজে তারা অন্য পেইজে যাওয়ার চিন্তা করবে না।
এভাবে কাস্টমার সার্ভিসের গুরুত্ব আসলে অনেকভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়, তুলে ধরা যায়। তবে সব কথার শেষ কথা হচ্ছে, কাস্টমার সার্ভিস ভালো না দিলে কোনো উদ্যোক্তাই টিকে থাকতে পারে না। সেরা কাস্টমার সার্ভিস দেয়াই হোক তাই দেশীয় পণ্যের উদ্যোক্তাদের UVP -Unique Value Proposition, অর্থাৎ হাজারো উদ্যোক্তা থেকে আপনাকে আলাদা করার হাতিয়ার।
লেখকঃ রাজিব আহমেদ,
প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং
খাতুনে জান্নাত আশা, প্রতিনিধি, টেকজুম ডট টিভি