আশরাফ উদ্দিন সরকার, পেশায় একজন শিক্ষক ( প্রভাষকঃতথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি, মিরকাদিম হাজি আমজাদ আলী ডিগ্রি কলেজ) । শিক্ষকতার পাশাপাশি শখের বশে ধরে রেখেছেন কৃষিকাজ। মূলত পূর্বপুরুষদের পেশার এই গতিকে চলমান রাখতেই তার এই প্রচেষ্টা। এই বছরের শুরুতে নিজ জমির প্রায় ৭ শতাংশ জায়গাতে ১০০ কলা গাছের চারা রোপন করে শুরু হয় তার কলাচাষের জার্নি। কলা চাষের পুরো জার্নিতে পরিবারের সহযোগিতার হাত থাকলেও চাষাবাদ করে পাওয়া এত কলা কিভাবে বিক্রি হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যেতো।
কিন্তু শিক্ষকের এই শখের বাগানের শত শত কলা নিমিষেই বিক্রি হয়ে গেলো ফেসবুক প্রফাইলে।ফেসবুক প্রফাইলকে কাজে লাগিয়ে মাত্র ১ লাখ টাকার কলা বিক্রি করেন আশরাফ উদ্দিন সরকার।
এই প্রসঙ্গে তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান যে, ” শুরু থেকেই তার পরিবারের চিন্তা ছিলো শখের বশে চাষ করা এই শতাধিক গাছের কলা কিভাবে বিক্রি হবে। সবার চিন্তা করে রাখা এই প্রশ্নের উত্তর আগে থেকেই জানতেন তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ের এই শিক্ষক। তার ভাষ্যমতে, বর্তমান যুগ এফ কমার্স এর যুগ। এই যুগে ফেসবুককে কাজে লাগিয়ে যে কোন কিছু প্রচার করা যায়,বিক্রি করা যায়। যেহেতু তার পার্সোনাল ব্রান্ডিং বেশ ভালো এবং ফেসবুক প্রফাইল খুবই সহজলভ্য একটা মাধ্যম তথ্য প্রচার করার। তাই এই দুই মাধ্যমকেই তিনি বেছে নিয়েছেন কলা বাগানের প্রচার করার জন্য।
তিনি কেবলমাত্র তার শখের বাগানের ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ, ছবি, লেখা ইত্যাদি শেয়ার করতেন ব্যাক্তিগত প্রফাইলে। কখনই কলা নিয়ে বিক্রির উদ্দেশ্যে লেখালেখি করতেন না। কিন্তু তার ভালো পরিচিতি এবং নিয়মিত প্রফাইলে লেখালেখি একটা সময়ে বেশ সাড়া ফেলে ফেসবুকে, এবং সেখান থেকেই তার বাগানের সব কলা বিক্রি হয়ে যায়।
মুন্সিগঞ্জ, ঢাকা, চট্টগ্রাম সহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয় তার বাগানের কলা। এবং কলা বিক্রির এই পুরো জার্নিটাই ছিলো অনলাইন নির্ভর। অনলাইন থেকে ক্রেতা পেতেন এবং পরবর্তীতে কুরিয়ারের মাধ্যমে ডেলিভারি দিতেন।
বাগানের প্রতি কাঁদি কলা সর্বনিম্ন ১০০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন তিনি। কলা চাষে সফল এই উদ্যোক্তার পরবর্তী পরিকল্পনা হচ্ছে, প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ জমিতে নতুন করে সাগর এবং সবরি জাতের কলার চাষ করা।
“ফেসবুক প্রফাইলে বিক্রি করে তিনি কতটুকু সফল” সেই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন,” আমি শুরু থেকেই ভেবে নিয়েছিলাম আমার কলা চাষ থেকে শুরু করে বিক্রি পর্যন্ত সব কিছু হবে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে। ছোটবেলা থেকেই চাষাবাদ করার কাজে জড়িত থাকার সুবাদে দেখেছি যে, প্রান্তিক পর্যায়ের চাষীরা কখনই পরিশ্রমের তুলনায় ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে পারেন না। কারন প্রান্তিক পর্যায় থেকে কয়েকটা ধাপে ধাপে পণ্যের মূল্যের পরিবর্তন ঘটে শেষ অবধি তা ভোক্তার নিকট পৌছায়।সেখানে আমি যদি বাগান থেকে সরাসরি ভোক্তাদের নিকট আমার পণ্য পৌছাতে পারি তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আমি আমার পরিশ্রমের ন্যায্য মূল্য পাবো । তাছাড়া বর্তমানে ফেসবুককে কাজে লাগিয়ে সব ধরনের কাজ করাই সম্ভব। তাহলে কলা বিক্রিই বা কেন নয়? “।
শিক্ষক আশরাফ উদ্দিন সরকারের এই ভীন্নধর্মী গল্প থেকে অনেক কিছুই শেখা যায়
*প্রথমত কোন পেশাই ছোট করে দেখার মত না।বরং যুগের সাথে তাল মিলিয়ে যে কোন পেশায় নিয়মিত কাজ করলে বেশ ভালো কিছু করা সম্ভব।
*বর্তমান ই-কমার্স এর যুগে আমাদের দেশের জন্য ফেসবুক প্লাটফরমটি আশীর্বাদস্বরূপ। চাইলে ফেসবুক প্রফাইল কে কাজে লাগিয়ে ই-কমার্স সেক্টরে খুব সুন্দর একটি অবস্থান তৈরি করা যায় নিজের।
*পার্সোনাল ব্রান্ডিং পণ্যের প্রচার এবং ক্রেতাদের দ্বারপ্রান্তে পৌছানোর ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
একটা সময়ে মুন্সিগঞ্জ এর রামপাল ইউনিয়ন ছিলো সাগর কলার জন্য বিখ্যাত। “সাড়ি সাড়ি কলার বাগান, লঞ্চ ঘাট এর নৌকা ভর্তি কলার কাঁদিতে ভরপুর” এর এই গল্পগুলো এখন যেনো রূপকথার জগতে হারিয়ে গিয়েছে। কলা চাষের প্রতি এই অনাগ্রহ, ঘাটতি নিয়ে একটি প্রচলিত বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে যে, ” কলা গাছে একধরনের কৃত্রিম রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়, যা মাটির উর্বরতা নষ্ট করে ফেলে,পাশাপাশি মাটিকে অন্যান্য সবজি চাষের জন্য অনুপযোগী করে ফেলে”। কিন্তু এটা কেবলই একটা গুজব।
বরং আশরাফ উদ্দিন এর কলা বাগানের একই জমিতে প্রায় দেড়শ মরিচ গাছের মরিচের ও বেশ ভালো ফলন দেখা যায়।
তার ভাষ্যমতে কৃষকদের এই চাষাবাদের প্রতি অনাগ্রহ তৈরির মূল কারন হচ্ছে পরিশ্রম এর তুলনায় ন্যায্য পাওনা না পাওয়া, পর্যাপ্ত দক্ষ কর্মী না পাওয়া, কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি।
মুন্সিগঞ্জের রামপালের বিলুপ্তপ্রায় সাগর কলার জন্য এক নতুন আশার সঞ্চার করেছেন শিক্ষক এবং উদ্যোক্তা আশরাফ উদ্দিন সরকার। কলা নিয়ে অনলাইন জগতে তার এই ভীন্নধর্মী যাত্রা সবার নিকট শিক্ষনীয় হয়ে থাকবে, পাশাপাশি জেলার বিখ্যাত পণ্যের নতুন জন্মের জন্য স্মরনীয় হয়ে থাকবে বলে আমরা আশাবাদী।
টেকজুম ডট টিভি র পক্ষ থেকে তার এই ভিন্নধর্মী যাত্রার জন্য প্রানঢালা শুভেচ্ছা এবং শুভকামনা রইলো।
ফারিয়া ওমর ঝুমুর
মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি, টেকজুম ডট টিভি