চড়েন গাড়িতে প্রায়ই ঘোরেন বিদেশে অর্থাৎ আর্থিকভাবে স্বচ্ছল কিংবা দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা আছে এমন নারী উদ্যোক্তারা সরকার থেকে নিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান। যারা অনুদান নিয়েছেন তাদের অনেকেই আবার বিভিন্ন আয়োজনে নিজেরাই করেন পৃষ্ঠপোষকতা। কেউবা আবার সফল নারী নেত্রী হিসেবে সাক্ষাৎকার দিয়ে আসছেন গণমাধ্যমে। কিন্তু সেই তাদেরকেই ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি আর ওয়েবসাইট তৈরির নামে দেওয়া হয়েছে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান। কথিত আছে, অনুদানের ৫০ হাজার টাকা নিতে এসব নারী উদ্যোক্তাদের অনেকেই এসেছিলেন দামি গাড়ি হাঁকিয়ে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভগের ‘উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠাকরণ (আইডিয়া)’ প্রকল্প থেকে নারী উদ্যোক্তাদের এই অনুদান প্রদান করা হয়। কয়েক দফায় প্রায় এক হাজার ২৫০ জন নারী উদ্যোক্তার প্রত্যেকে ৫০ হাজার টাকা করে এই অনুদান পান। উদ্যোক্তারা বলছেন, অনুদানের অঙ্ক নয় বরং ‘অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ’ হিসেবেই বিষয়টিকে দেখছেন তারা। সেই হিসেবে নারী উদ্যোক্তাদের এমন উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার মূল্য দাঁড়ায় ৬ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা, যা সরকারি অর্থ। প্রথম দফায় ২০২২ সালের ৮ আগস্ট মোট ২৫০ জন নারী উদ্যোক্তাদের এই অনুদান প্রদানের মধ্যে দিয়ে এর কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম দফাতেই ছিলেন ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাব মনোনীত অন্তত ২০ জন নারী উদ্যোক্তা। ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি আর ওয়েবসাইট তৈরির জন্য ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়ার সাত মাস পেরিয়ে গেলেও কারও ওয়েবসাইট এখনও ‘লাইভ’ অর্থ্যাত প্রকাশ্যে আসেনি। তালিকায় এমন নারী উদ্যোক্তারাও আছেন যাদের আগে থেকেই ওয়েবসাইট আছে।
অভিযোগ আছে, ২০২২ সালে ই-ক্যাবের কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচনে ‘অগ্রগামী প্যানেল’ এর প্রচার ও প্রচারণায় যেসব নারীরা ছিলেন তাদের অধিকাংশই আছেন অনুদান পাওয়া প্রথম ২০ জন নারী উদ্যোক্তার তালিকায়। নির্বাচিত নয়টি পরিচালক পদের মধ্যে সভাপতি শমী কায়সার এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমালসহ আটটি পদেই জয় লাভ করে অগ্রগামী প্যানেলের প্রতিদ্বন্দ্বী। কোন কোন নারী উদ্যোক্তা না চাইলেও একরকম ‘কৃতজ্ঞতা’ প্রকাশের নিদর্শন হিসেবে অনুদানের আবেদন ফর্ম পূরণ করানো হয়েছে তাদেরকে দিয়ে। আবার পছন্দের নারী উদ্যোক্তাকে সরকারি অনুদান পাইয়ে দিতে তড়িঘড়ি করে দেওয়া হয়েছে ই-ক্যাবের সদস্যপদ। তালিকায় আছেন সাধারণ সম্পাদকের শ্যালিকা, ই-ক্যাব কার্যালয়ের কর্মকর্তার বোন, পরিচালকেরা সহধর্মিণী এবং বিভিন্ন স্ট্যান্ডিং কমিটিতে থাকা নারী নেত্রীরা।
অনুদান পাওয়া জাফরিন’স ফ্যাশনের স্বত্তাধিকারী ও ই-ক্যাব সদস্য (নং-২২৬) জাফরিন ইসলাম বলেন, নির্বাচনের পরেই একদিন মেসেজ আসলো ই-ক্যাব অফিসে গিয়ে আবেদন করতে। যেহেতু আমি দেশি পণ্য নিয়ে কাজ করি না,তাই ধরেই নিয়েছিলাম কোন সংগঠন থেকে আমি কোন সাহায্য পাবো না। তাই আবেদন করা নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। কিন্তু ই-ক্যাব থেকে বার বার বলা হয় আবেদন করতে। পরে আবেদন ফর্ম পূরণ করে পাসপোর্ট সাইজ ছবি আর জাতীয় পরিচয় পত্রসহ জমা দেই আইসিটি বিভাগে। পরে যখন অনুদান পাই তখন সাধারণ সম্পাদক তমালকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, আমাকে কিভাবে এখানে নির্বাচন করা হলো। তমাল বলেছিলেন যে, যারা নির্বাচন এর প্রচারণা করেছে তাদেরকেই ই-ক্যাব থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
নওরিন’স মিরর নামক একটি ই-কমার্সের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে এই অনুদান পেয়েছেন হোসনেআরা খান নওরিন। ২০১৮ সাল থেকে ই-ক্যাবের সদস্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে নওরিনের ‘নওরিন’স মিরর’। নওরিন একজন সফল উদ্যোক্তা ও নারী নেত্রী হিসেবে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে থাকেন। ই-ক্যাবের কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক স্ট্যাডিং কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন নওরিন। পরের মেয়াদে মেম্বার অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন। এই নারী উদ্যোক্তার পারিবারিক মালিকানায় রয়েছে ১৫০০ সিসির গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-গ-২৮-****)। প্রায়ই দেশে ও দেশের বাইরে বিলাসবহুল ভ্রমণে যান। ২০২২ সালে ই-ক্যাবের একাংশের সাথে সফর করেন ভারতের কাশ্মির। চলতি মাসে ই-ক্যাবের পিকনিকে পৃষ্ঠপোষকতাও করেন অনুদান নেওয়া এই নওরিন। আর্থিকভাবে এতটা স্বচ্ছল হলেও সরকারি ৫০ হাজার টাকা অনুদান নেওয়ার প্রয়োজন হলো কেন এমন প্রশ্নের জবাবে নওরিন বলেন, এটা তো এমন ছিল না যে যারা গরীব বা দুস্থ শুধু তারাই অনুদান পাবে। এটা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। অনুদানের টাকা দিয়ে কী করেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে নওরিন বলেন, ওয়েবসাইট করেছি এবং কিছু ব্যবসার কাজে ব্যয় করেছি। কিন্তু ওয়েবসাইট বিশ্লেষণী প্ল্যাটফর্ম ‘হু ইজ’ এর তথ্যমতে, ২০২০ সালেই তৈরি হয় নওরিন’স মিররের ওয়েবসাইট। আর একই বছরের ৬ এপ্রিল সেটি সর্বশেষ হালনাগাদ করা হয় অর্থ্যাত অনুদান পাওয়ার আগে।
অনুদান পাওয়া আরেক নারী উদ্যোক্তা হলেন ‘স্যাম দ্যা ক্রাফটার’ (নং-১৭২৮) এর স্বত্ত্বাধিকারী নাফিসা তাসনিম সামান্থা। অভিযোগ আছে, ই-ক্যাব কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক ফারহাত মেহজাবিন সামিরার বোন নাফিসাকে অনুদান পাইয়ে দিতে তড়িঘড়ি করে তাকে সদস্যপদ দেওয়া হয়। ই-ক্যাবের ওয়েবসাইটে থাকা তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালের ২০ জুলাই সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় ‘স্যাম দ্যা ক্রাফটার’। এর ঠিক সাত দিন পরেই ই-ক্যাব মনোনীত নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে হোয়াটস অ্যাপে একটি গ্রুপ চ্যাট খোলা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নাফিসা তাসনিম সামান্থার আর্থিকভাবে খুবই স্বচ্ছল। নেপাল, মালদ্বীপ এবং থাইল্যান্ডের মতো দেশে বেড়াতে যান তিনি, নেন প্যারাজাম্পিং এর মতো বিলাসবহুল রোমাঞ্চের অভিজ্ঞতা। অনুদানের বিষয়ে জানতে নাফিসার সাথে প্রতিবেদকের আট মিনিটব্যাপী কথোপকথন হলেও আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
পশ ওয়ার্ল্ডের স্বত্তাধিকারী হিসেবে অনুদান পেয়েছেন নুজহাত আখতার। জানা যায়, নুজহাত আখতার সম্পর্কে ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক তমালের শ্যালিকা। পশ ওয়ার্ল্ডের ই-ক্যাব সদস্যপদ নম্বর নিয়েও আছে ধোঁয়াশা। অনুদান গ্রহণের পর ফেসবুকের ই-ক্যাবের গ্রুপে দেওয়া এক পোস্টে নুজহাত সদস্য নম্বর হিসেবে ৩৬৩ লেখেন কিন্তু ই-ক্যাব ওয়েবসাইটে এই নম্বরে ক্রিস্টাল টেকনোলজি বাংলাদেশ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন দেখা যায়। আর পশ ওয়ার্ল্ডের সদস্যপদ নম্বর দেখা যায় ৬১৬। এবিষয়ে জানতে নুজহাতে মুঠোফোনে কল করা হলে অপরপ্রান্ত থেকে বলা হয় তিনি দেশের বাইরে রয়েছেন।
৭২১ নম্বরের সদস্যপদ নিয়ে ২০১৫ সাল থেকে ই-ক্যাবের সদস্য হিসেবে রয়েছে ‘লেইসফিতা’। লেইসফিতা’র প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে অনুদান পাওয়া তানজিয়া নাসরিন ই-ক্যাবের বর্তমান কমিটির পরিচালক অর্ণব মোস্তফার সহধর্মিণী। নির্বাচনের পর ই-ক্যাব কার্যনির্বাহী কমিটির পছন্দে বিনাভোটেই পরিচালক হয়েছেন অর্ণব। এবিষয়ে তানজিয়া বলেন, ই-ক্যাব থেকে আমাদেরকে যে এভাবে মনোনয়ন করে দেওয়া হয়েছে এটা আমাদের জন্য উপকারি হয়েছে। আমাদের ওয়েবসাইট আগেই করা ছিল কিন্তু ডেভেলপমেন্টের জন্য তো টাকা লাগে। আর অনুদান পেলে কে না নেয়?
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট সহ বিভিন্ন আইটি সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠান টেকনো এইড বিডি’র (নং-১৫৯) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাফরুজা আক্তার নিজের ওয়েবসাইট তৈরির জন্য অনুদান নিয়েছেন। ই-ক্যাবের উইমেন এন্টারপ্রেনার্স ফোরাম সম্পর্কিত স্ট্যান্ডিং কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাফরুজা। ৫ লক্ষ টাকার চেক জালিয়াতির এক মামলায় গেল নভেম্বরে গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি। এদিকে টেকনো এইড বিডি’র নিজস্ব ওয়েবসাইটই সচল নেই। ওয়েবসাইটের কাজ হচ্ছে জানান মাফরুজ তবে মামলার বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
‘আখি’স কালেকশন’ নামক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও স্বত্তাধিকারি সালমা রহমান আখি। নিজস্ব কারখানায় তৈরি পোশাক বিক্রি করেন আখিস কালেকশনে। ২০১৮ সাল থেকে ই-ক্যাবের সদস্য এই প্রতিষ্ঠান তবে ব্যবসার শুরু সেই ১৯৯৮ সাল থেকে। বিভিন্ন সময় ই-ক্যাবের নানা পদে দায়িত্ব পালন করে আসছেন আখি। বর্তমান কমিটির উইমেন ফোরামের কো-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। অনুদান সম্পর্কে জানতে চাইলে সালমা রহমান আখি বলেন, এই টাকা দিয়ে আমরা ওয়েবসাইট করেছি। সর্বোপরি আমরা উৎসাহিত হলাম।
ই-ক্যাবের পুরনো নারী সদস্যদের মাঝে অনুদান গ্রহীতাদের মাঝে আরও আছেন ‘বাহারিকা’র প্রতিষ্ঠাতা সাদিয়া মিতু। ২০১৮ সাল থেকে ই-ক্যাবের এই সদস্য সংগঠনটির কার্যনির্বাহী কমিটির সর্বশেষ নির্বাচনে অগ্রগামী প্যানেলের পক্ষে প্রচার প্রচারণা চালিয়েছেন।
এই অনুদান প্রদানের অন্যতম যে উদ্দেশ্য ওয়েবসাইট ডেভেলপ করা সেটি সাত মাসেও তৈরি করতে পারেননি আগে থেকেই ওয়েবসাইট না থাকা নারী উদ্যোক্তাদের কেউই। অনুদানের অর্থ কিভাবে খরচ করা হয়েছে সেবিষয়ে একটি প্রতিবেদন আইডিয়া প্রকল্পে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই প্রতিবেদন এখনও কোন নারী উদ্যোক্তার পক্ষ থেকে জমা পড়েনি বলে নিশ্চিত করেছেন আইডিয়া প্রকল্পের পরিচালক আলতাফ হোসেন। এমনকি অনুদান পাওয়া নারী উদ্যোক্তাদের পূর্ণ তালিকা চাইলেও পাওয়া যায়নি আইডিয়া প্রকল্প থেকে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইসিটি বিভাগের একটি সূত্রের দাবি, বিভিন্ন মহলের সুপারিশের প্রেক্ষিতে অনেক নারী উদ্যোক্তাদেরকে এই অনুদানের তালিকায় রাখা হয়। প্রায় ৩০০ জন নারী উদ্যোক্তার আবেদন সঠিকভাবে যাচাইবাছাইও করা হয়নি। তবে এসব বিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি আলতাফ হোসেন।