রাজধানীতে কসমেটিকস বা প্রসাধনী পণ্য কেনার ক্ষেত্রে গ্রাহকদের কাছে একসময় পছন্দের স্থান ছিল নিউমার্কেট ও চকবাজার। ভেজাল ও ভুয়া পণ্যে এসব বাজার সয়লাব হওয়ায় গ্রাহকরা ঝুঁকতে থাকেন নামিদামি ব্র্যান্ড আর অনলাইন শপে। অনলাইনভিত্তিক ব্র্যান্ডগুলোর ওপর আস্থা আসতে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের পণ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। গ্রাহকদের প্রশ্ন, প্রসাধনী পণ্যে তারা আস্থা রাখবেন কোথায়?
২০১৩ সালে কনটেন্ট সাইট হিসেবে যাত্রা শুরুর পর ২০১৮ সালে প্রসাধনী পণ্য বিক্রয়কারী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান হিসেবে সামনে আসে সাজগোজ ডটকম। স্বল্প সময়ে বিপুলসংখ্যক গ্রাহক আকর্ষণে সক্ষম হয় তারা। ফলে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ২১ কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগও পায়। প্রসাধনী পণ্য কেনার ক্ষেত্রে গ্রাহক ও ভোক্তার একরকম অন্ধবিশ্বাস ছিল সাজগোজ ডটকমের প্রতি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক অভিযানে সেই বিশ্বাস ভাঙে অনেকের।
গত ৭ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটির বেইলি রোড শাখায় অধিদপ্তরের অভিযানে বিদেশি পণ্য আমদানির কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি সাজগোজ। এ অপরাধে তাদের ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এদিকে অভিযানের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তেই তা ভাইরাল হয়ে যায়। নেটিজেনদের অনেকেই তখন সাজগোজ নিয়ে নিজেদের অভিযোগ জানাতে থাকেন।
সাজগোজ একদিকে যেমন আমদানিকারকের স্টিকার ও কাগজপত্র দেখাতে পারেনি, তেমনি পোল্যান্ডের ফ্র্যাঞ্চাইজি দাবি করা আরেক দামি ব্র্যান্ড ‘ইংলট’-এর শোরুমে পাওয়া গেছে মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য। প্রতিষ্ঠানটির বনানী ব্র্যাঞ্চে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া পণ্যের উপস্থিতি পায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তাদের ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়।
হালিমা ইয়াসমিন নামে একজন বলেন, সাজগোজ থেকে নিয়মিত কেনাকাটা করতাম, কারণ আমাদের বিশ্বাস ছিল তারা প্রত্যাশা পূরণ করছেন। কিন্তু এ ঘটনায় তাদের পণ্য আসল কি না, সেই প্রশ্ন জাগছে।
সাজগোজ ডটকমের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী নাজমুল শেখ বলেন, যারা ভিডিওটি পোস্ট করেছিলেন, সেখানে যে শিরোনাম ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি বোধহয় অপরাধ হয়েছে। ওই ভিডিও দেখে গ্রাহকদের মাঝে বিভ্রান্তি তৈরি হয়নি, বরং ভুল শিরোনামে তুলে ধরা ভিডিও থেকে হয়েছে।
এদিকে মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রিতে কর্মীদের দোষ দেখছে ইংলট বাংলাদেশ। এক লিখিত জবাবে তারা বলে, মূলত নোংরা প্রতিযোগীরা তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক লাভ চরিতার্থের জন্য বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে এবং ইংলট বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সুনাম নস্যাৎ করতে আমাদের একজন অসৎ কর্মীর মাধ্যমে এ হীন কাজ অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়েছে।
অধিদপ্তর বলছে, গ্রাহক ও বিক্রেতা উভয়পক্ষকে সচেতন করতেই নিয়মিত অভিযান এবং এর ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে। অধিদপ্তরের উপপরিচালক আফরোজা রহমান বলেন, আমাদের অভিযানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গ্রাহক ও ভোক্তা এবং ব্যবসায়ীদের সচেতন করা। গ্রাহক একটা পণ্য কেনার আগে যেমন কিছু বিষয় দেখে কিনবেন, তেমনি ব্যবসায়ীরাও পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মেনে চলবেন।
জার্মানভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার এক তথ্যমতে, বাংলাদেশে ‘বিউটি অ্যান্ড পার্সোনাল কেয়ার’ পণ্যের ২০২৩ সালের বাজারের আকার প্রায় ৯.৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২২ সালে এটি ৯.১০ মিলিয়ন ডলার ছিল। বিশাল এই বাজারের অধিকতর প্রবৃদ্ধি অর্জনে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও প্রযুক্তিভিত্তিক সমাধান অন্তর্ভুক্ত করা এবং দক্ষ জনবল নিয়োগে বিনিয়োগের পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
প্রসাধনী বিক্রয়কারী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সাম্পান ডটকমের উপদেষ্টা আব্দুল্লাহ আল মামুন আকাশ বলেন, পণ্য বেচাকেনায় যে সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়, সেটিতেই ‘ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট’ করা যায়। এ সফটওয়্যার পণ্য মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগেই জানান দেবে, হয়ে গেলে সতর্ক করবে। এটা যেহেতু অনেক বড় বাজার তাই গ্রাহক এবং ভোক্তার প্রতি প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা দায়বদ্ধতা আছে।
এদিকে প্রসাধনীর মতো পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে সচেতনতার পরামর্শ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শেখ আরিফুর রহমান বিপুল বলেন, এ ধরনের পণ্য সরাসরি মানুষের ত্বকে বা শরীরে ব্যবহৃত হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ বা ভেজাল পণ্যের ব্যবহার মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন ক্যান্সার এবং অ্যালার্জির মতো রোগও হতে পারে। কাজেই কসমেটিকস পণ্য কেনার ক্ষেত্রে যথাসম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সেগুলো কেনা।
পাশাপাশি প্রসাধনী পণ্যের কেনার সময় বিএসটিআইর অনুমোদন, বিদেশি পণ্য হলে আমদানিকারকের স্টিকার এবং মেয়াদের তারিখ দেখার পরামর্শও দেন এ চিকিৎসক।
মেয়াদোত্তীর্ণ বা ভেজাল পণ্যের ব্যবহার মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন ক্যান্সার এবং অ্যালার্জির মতো রোগও হতে পারে। কাজেই কসমেটিকস পণ্য কেনার ক্ষেত্রে যথাসম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সেগুলো কেনা