বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের ঢাকা বিভাগের একটি জেলা শরীয়তপুর। পদ্মা সেতুকে মূল উপজীব্য করে শরীয়তপুরের আর্থ-সামাজিক বিকাশের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বাংলা ভূখণ্ডের পুরাতন জেলাগুলোর মধ্যে শরীয়তপুর অন্যতম। এ জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৮ শতকে। এরমধ্যে অনেক সংযোজন ও বিয়োজন হলেও মানুষের হাত ধরে বছরের পর বছর ধরে টিকে আছে কিছু পেশা। কাসা ও মৃৎশিল্প অন্যতম। কারিগরদের সুনিপুন দক্ষতায় তৈরি হওয়া এসব পণ্য স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি দেশের অন্য জেলার চাহিদাও পূরণ করছে। এতে করে বাড়ছে কারিগরদের আয় এবং শরীয়তপুরের অর্থনীতি। শরীয়তপুরের জেলা ব্র্যান্ডিং ও কারিগরদের আয় রোজগার বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি। শরীয়তপুর থেকে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেতে পারে এমন ৫টি পণ্যের কথা তুলে ধরছি-
১. মৃৎশিল্প: শরীয়তপুরকে বলা হয় মৃৎশিল্পের শহর। ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর ইউনিয়নের কার্ত্তিকপুর গ্রামে ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে কুমার সম্প্রদায়ের লোকেরা উৎপাদন করে আসছে বিভিন্ন রকমের মাটির তৈরি খেলনা, শো-পিচ, তৈজস্বপত্র, মটকা, হাড়ি-পাতিল ইত্যাদি। আগের কেবল গৃহস্থালির পণ্য উৎপাদন হলেও নতুন প্রজন্মের পালরা ঘটিয়েছে আধুনিকতার অনুপ্রবেশ। মানুষের রুচি পরিবর্তনের সাথে মাটির তৈরি জিনিসপত্রে ক্রিয়েটিভিটি প্রকাশের মাধ্যমে চাহিদার সবটুকু পূরণের চেষ্টা করছে শিল্পিরা। বংশ পরম্পরায় এ পেশা ধরে রেখেছে কুমার সম্প্রদায়। দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শরীয়তপুরের মৃৎশিল্পের পণ্য ইউরোপ, আমেরিকা অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর অন্তত ২০ দেশে রপ্তানি হয়। এরফলে মৃৎশিল্পের হাত ধরে কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আসছে শরীয়তপুরে। দেশের সনামধন্য প্রতিষ্ঠানের শোরুমের চাহিদা পূরণেও অবদান রাখছে শরীয়তপুরের পাল সম্প্রদায়। মৃৎশিল্পকে কেন্দ্র করে কার্তিতকপুর গ্রামের পালপাড়া এলাকায় ১৯৭৮ সালে গড়ে উঠেছে ৪টি শিল্প প্রতিষ্ঠান। এর ফলে কুমারদের জীবিকা নির্বাহ হলেও মানুষের কাছে অজানা থেকে যায় শরীয়তপুরের ব্র্যান্ডিং। শরীয়তপুরের মৃৎশিল্প জিআই পণ্যের মর্যাদা লাভ করলে বাড়বে পরিচিতি, চাহিদা ও কর্মসংস্থান। পরিবারের লোকজন ব্যতীত চারশত এর বেশি কর্মী কাজ করছে এ শিল্পে। হালের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে মৃৎশিল্পের পণ্য নিয়ে অনেকে কাজ করছেন অনলাইনে। মাটির তৈরি জিনিসপত্র ভূমিকা রাখে বাঙালি ঐহিত্য ধরে রাখতে।
২. নড়িয়ার সন্দেশ: শতাধিক বছর ধরে শরীয়তপুরে উৎপাদন হওয়া পণ্যগুলোর মধ্যে নড়িয়ার সন্দেশ অন্যতম। এই সন্দেশের ঐতিহ্য একশত বছরের বেশি। ঘোষ সম্প্রদায়ের লোকেরা মিষ্টি ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। তাদের মাধ্যমে উৎপাদন শুরু হয় এক প্রকার সন্দেশের। যার স্বাদ ও আকৃতি অন্য সন্দেশের চেয়ে আলাদা। এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে ধারাবাহিকভাবে এখনো উৎপাদন করছে নড়িয়া উপজেলার মিষ্টি ব্যবসায়ীরা। যা স্থানীয় মানুষজনসহ আশেপাশের মানুষের মাধ্যমে যায় বিভিন্ন জেলায়। আগের পরিচিতি ও সুনাম এখনো অক্ষত। শত বছর পূর্বে কীর্তিনাশা নদীপথে নড়িয়া বন্দর ছিল শরীয়তপুরে। এই বন্দর দিয়ে সাধারণ মানুষ ও ভারতীয় ব্যবসায়ীগণ যাতায়াত করত এবং যাত্রা পথে বন্দরে দিত বিরতি। তারা সাথে করে কলকাতায় নিয়ে যেতো নড়িয়ার সন্দেশ। এভাবে কলতাকাসহ অন্যান্য স্থানে পরিচিতি ও সুনাম ছড়িয়ে পড়ে এই সন্দেশের। কীর্তিনাশা নদী, আবহাওয়া আর এ অঞ্চলের দুধের প্রভাবে স্বাদে অনন্য হয় নড়িয়া বাজারের সন্দেশ। এই সন্দেশের জিআই স্বীকৃতি পেলে টিকে থাকতে স্বতন্ত্র পরিচিতি, বাড়বে চাহিদা, কর্মসংস্থান ও জেলা ব্র্যান্ডিং।
৩. কাসা শিল্প: শরীয়তপুর সদর উপজেলার একটি গ্রামের নাম দাসার্ত্তা। এ গ্রামে কংশবণিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে শতবর্ষ ধরে উৎপাদন হচ্ছে কাসা-পিতলের নানা রকম দ্রব্যসামগ্রী। তাদের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম এটি। একটা সময় মুখরিত থাকতো হাতুড়ি ও কাসার ঝনঝন শব্দ। এখনো কিছু হিন্দু পরিবার ধরে রেখেছে তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশা। তারা তৈরি করছে কাসার কলস, বালতি, ল্যাম্প, পানদানীসহ নানারকম দ্রব্যসামগ্রী। এখানকার কাসা শিল্পিদের তৈরি সামগ্রী শরীয়তপুরসহ সারাদেশের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। যেহেতু এটি শরীয়তপুরের আদি পেশার মধ্যে অন্যতম তাই এটিকে জিআই স্বীকৃতির আওতায় আনতে কাজ করা দরকার। জিআই স্বীকৃতি পেলে জেলা ব্র্যান্ডিং এর পাশাপাশি পরিচিতি ও বাজার বাড়বে কাসা শিল্পের। এরফলে রপ্তানি সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে। নতুন করে আরও কিছু মানুষ যুক্ত হতে চাইবে কাসা শিল্পে। নতুন প্রজন্মের অনুপ্রেবশ ঘটলে মানুষের চাহিদা বুঝে পণ্যে আনবে নতুনত্ব। যা শরীয়তপুরের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে। এছাড়াও ই-কমার্সের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে আগ্রহী হবে ই-কমার্স উদ্যোক্তারা। পদ্মা সেতু হয়ে যাওয়ার কারণে আরও উন্নত পরিবহণ সুবিধা পাচ্ছে ই-কমার্স উদ্যোক্তারা। তাই এই শিল্পের জন্য নতুন সম্ভাবনা হাত ছানি দেয়।
৪. বিবিখানা পিঠা: শরীয়তপুরের একটি বিখ্যাত পিঠার নাম বিবিখানা পিঠা। এটিকে আঞ্চলিকভাবে জামাই ভুলানো পিঠাও বলা হয়। এই পিঠা তৈরি করতে হলে বিশেষ দক্ষতা, পারদর্শীতা ও গুণের পরিচয় দিতে হয়। তা তৈরি করে বাড়ির বউ কিংবা কনেরা। গ্রামের ভাষায় বউদের বিবিও বলা হয়। কেউ কেউ ধারণা করছে এ কারণে নামকরণ হয়েছে বিবিখানা পিঠা। আবার কেউ কেউ মনে করেন প্রাচীনকালে এক ধনীর বিবির জন্য প্রথম এই পিঠা তৈরি হওয়ার কারণেই নামকরণ হয়েছে বিবিখানা পিঠা। ধারণা করা হয় বহুবছর আগে থেকে শরীয়তপুরে উৎপাদন হয় বিবিখানা পিঠা। এর সাথে মিশে আছে স্থানীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এ কারণে বিবিখানা পিঠার প্রচলন বেশি এই অঞ্চলে। শরীয়তপুরের জিআই পণ্য বাড়ানোর লক্ষ্যে বিবিখানা পিঠা নিয়ে চেষ্টা করার সুযোগ রয়েছে। এরফলে জেলার জিআই পণ্যের সংখ্যা বাড়বে। বর্তমানে যেহেতু ই-কমার্সের মাধ্যমে পিঠা সর্বত্র বিক্রি হয় তাই বিবিখানা পিঠার জিআই স্বীকৃতি পেলে রাজধানী ঢাকাসহ সর্বত্র বাড়বে এই পিঠার কদর। যা জেলা ব্র্যান্ডিং ও অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে।
৫. টেরাকোটা: প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থাপনায় ব্যবহার হয়েছে টেরাকোটা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, শালবন বিহার, কান্তজির মন্দির, ষাটগম্বুজ মসজিদ ইত্যাদি। এসব স্থাপনা প্রমাণ করে কয়েকশত বছর ধরে উৎপাদন ও ব্যবহার হয় টেরাকোটা। এটি মৃৎ শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ফলক। শরীয়তপুরের প্রাচীন শিল্পের মধ্যে মৃৎশিল্প অন্যতম। শুরু থেকে বিভিন্ন রকমের মাটির খেলনা, শো-পিচ, তৈজস্বপত্র, মটকা, হাড়ি-পাতিল ইত্যাদি উৎপাদনের প্রমাণ পাওয়া যায়। তখনকার সময় টেরাকোটার চাহিদাও ছিল বাংলাদেশে। এ কারণে ধারণা করা হয় শরীয়তপুরেরও উৎপাদন হয়েছে টোরাকোটা। তাই প্রচাীন বই, পত্রিকা, ম্যাগাজীন স্থাপনা ও কিংবদন্তিতে অনুসন্ধান করার মাধ্যমে প্রমাণ করা যেতে পারে। যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে জিআই স্বীকৃতির চেষ্টা করা যেতে পারে শরীয়তপুরের টেরাকোটার। তাহলে এই প্রাচীন ফলক নিয়ে সর্বত্র আলোচনা ও ব্যবহার বাড়বে এবং সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাসহ সৌখিন মানুষের নির্মানে স্থান পাবে। এতে করে বাড়বে শরীয়তপুরের ব্র্যান্ডিং, কর্মসংস্থান, আর্থিক লেনদেন ইত্যাদি। এই প্রজন্মের মৃৎশিল্পিরা যুগের চাহিদা বুঝে তৈরি করতে পারবে টেরাকোটা। যেমনটা কয়েক বছর আগে করা হয়েছিল পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে। শরীয়তপুরের মৃৎশিল্পিরা ক্রিয়েটিভিটি এবং যুগের চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। যেমনটা আমরা তৈজস্বপত্র উৎপাদনেও দেখতে পাই। আগেকার যুগে যেমন মটকা, হাড়ি-পাতিল বা পুতুল ব্যবহার বেশি হতো, তখন এসব পণ্য উৎপাদনও বেশি হতো। বর্তমান যুগের মানুষ খেলনা, শো-পিচ, তৈজস্বপত্র ইত্যাদি সংগ্রহ করে তাই এ প্রজন্মের শিল্পিরা চাহিদা বুঝে বিভিন্নরকম রংবেরঙের পণ্য উৎপাদন করে থাকে। তাই বলা যায় তারা মানুষের চাহিদা বুঝে নতুনত্বকে প্রাধান্য দিবে।
লেখক: স্বত্বাধিকারী, আলিয়া’স কালেকশন।